-->

সংযমের মাসে অসংযম কেন?

মোস্তফা কামাল
সংযমের মাসে অসংযম কেন?

একসঙ্গে বেশি পণ্য না কেনাও রমজান মাসের শিক্ষা। মাসটির পবিত্রতা রক্ষার তাগিদও এখানে। কিন্তু এভাবে বললে বা আহব্বান জানালে মনোকষ্টে আক্রান্ত হওয়ার বহু মানুষ রয়েছেন। সাধারণ শিক্ষিতদের চেয়ে এ দিকটির ধর্মীয় ব্যাখ্যার জন্য বেশি উপযুক্ত আলেম-ওলামারা। চাইলে অনেক ভ‚মিকা রাখার সুযোগ তাদের। বাস্তবে সেখান থেকে এ বিষয়ক ওয়াজ-খুতবার ব্যাপক ঘাটতি স্পষ্ট।

 

রমজান বা রোজার প্রধান শিক্ষা সংযম সাধন। খাদ্য-ভোগ্য যে কোনো পণ্য মজুত ইসলামে মস্ত অপরাধ। নৈতিকতাও তা অনুমোদন দেয় না। এ অপরাধের কঠোর শাস্তির কথা ধর্মে এবং প্রচলিত আইনে থাকার পরও সংযমের মাসটিতে দুঃখজনকভাবে অসংযমের একটি দৌড় জমে।

 

এবার তা মাত্রা ছাড়ানো এবং রোজা শুরুর আগেই। সামর্থ্যে অকুলান ব্যক্তিও যা পারছেন কিনে ঘর ভরছেন। পেশাদার আড়তদার-মজুতদারদের সমান্তরালে বাজারে ক্রাইসিস তৈরিতে কিছু ভূমিকা রাখছেন তারাও।

 

বাজার পরিস্থিতিতে পেশাদার মজুতদারদের বিরুদ্ধে সরকারি মহল থেকে কড়া হুমকি-ধমকি দেয়া হচ্ছে গত বছর খানেক ধরে। কৃত্রিম ওপায়ে কোনো পণ্যের সংকট সৃষ্টি করলে অবৈধ মজুতের দায়ে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার হুঁশিয়ারি রোজার আগে আরো বেড়েছে। সেই দৃষ্টে বাজারে কিছু নজরদারি ও তদারকি চলছে।

 

কিন্তু ফলাফল আগের মতোই। কে শোনে কার কথা! বিক্রেতারা মুনাফা হাতানোর যত ব্যবস্থা আছে একটিও ছাড়ছেন না। ক্রেতারাও অস্থির। পচনশীল পণ্যও বেশি করে কিনে নিশ্চিন্ত হওয়ার মানসিকতা অনেকের। রোজা শুরুর ঢের আগ থেকেই এবার মাছ-মাংসের বাজার বেদম চড়া।

 

মাংস-মাছ, ডিম থেকে শুরু করে ছোলা, ডাল, চিনি, খেজুর এমনকি কাঁচা সবজির দাম পর্যন্ত বাড়তি। বেগুন, শসা, গাজর, টমেটো, লেবু, পেঁয়াজের ছোটখাটো আড়ত গড়ে উঠেছে কারো কারো ঘরে।

 

যুক্তিতে বা তর্কে টনটনে এই শ্রেণির ক্রেতারা। যথেচ্ছা কেনাকাটায় নিজেদের স্বাধীন-সার্বভৌম ভাবতে অভ্যস্ত তারা। এই শ্রেণিটির এমন মানসিকতা বিক্রেতাদের জন্য মহাসুযোগ ও মহানন্দের। তারা ব্রয়লার মুরগির দাম ঠেকিয়েছেন ২৬০-২৭০ টাকায়। গরিবের মাছ নামে পরিচিত চাষের পাঙাশ-তেলাপিয়ার কেজি ২০০-২৫০ টাকায় তুলেছেন।

 

রোজা-রমজান-ঈদ মৌসুমে চাল, ডাল, চিনি, সয়াবিন তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু পণ্যের উচ্চমূল্য বাংলাদেশে অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। অনেকটা সংস্কৃতির মতো। কিন্তু এবার এসব পণ্যের দাম বেড়ে আছে আগে থেকেই। রমজান সামনে রেখে আরেক দফা ঢোলে বাড়ি।

 

রমজানে রোজাকে ফরজ করার আসল উদ্দেশ্য হলো মানুষকে সংযমে অভ্যস্ত করা। রমজানকে সংযমের মাস বলার কারণ এখানেই। এ সংযম কেবল খাওয়ায় নয়, চলাফেরা, কথাবার্তাসহ যাবতীয় কর্মে। শুধু ঘরে নয়, বাইরেও। ব্যক্তিজীবন থেকে শুরু করে পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সবখানেই সংযমি হওয়ার মহান বার্তা নিয়ে আসে মাহে রমজান।

 

কিন্তু দুঃখজনকভাবে সংযমের মাসকে সামনে রেখে না বুঝে বা অতি বুঝে সংযমকে ফেরারি করে দেয়ার আলামত। ব্যবসায়ী, আড়তদার, মজুতদার, ফড়িয়া, বিক্রেতা, ক্রেতা কেউ কারো চেয়ে কম যাচ্ছে না। অথচ ইসলামে এ অবস্থা থেকে সরে আসা বা নিজেকে শোধরানোর উত্তম সময় বলা হয় মাহে রমজানকে। বাস্তবটা বড় বিপরীত।

 

সংযম চর্চার আনুষ্ঠানিক এই মৌসুমে অর্থনৈতিক থেকে শুরু করে জীবনের আরো বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসংযমের রিহার্সাল। তা খাওয়া-দাওয়া পর্যন্ত। দিনভর উপবাসের পর বাহারি ইফতার, ইফতারের পর আরেক দফা খাওয়া, ঘণ্টা কয়েক পর সেহরিতে মুখরোচক সামগ্রীর পসরা সাজানোর প্রতিযোগিতা ধর্মের কোথাও নেই। বরং বারণ রয়েছে। সকাল-সন্ধ্যা উপোস থাকাকেই রোজা মনে করে আত্মপ্রসাদে ভোগার সুযোগ নেই।

 

তা না মেনে খাদ্যের যোগফল অনেক বাড়ানো হচ্ছে। এবার সময়ও একটি ঘটনা। গোটা বিশ্বের মন্দা দশা। দেশেও এর ছাপ। যেখানে সংযম-সাশ্রয় চর্চা সময়েরও দাবি। বিভিন্ন দেশে রমজানে মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই পণ্যদ্রব্যের দাম কমায়। এখানে মৌসুমটাকে করে ফেলা হয়েছে দাম বাড়ানোর প্রতিযোগিতার। মানুষকে জিম্মি করে মুনাফা হাতানো ইসলামে একদম অবৈধ। এখানে যদি, কিন্তু তবের কোনো অবকাশ নেই।

 

রোজা বা সংযম সাধনার চেয়ে ইফতার-সেহরির ম্যানু ঠিক করে ফেলা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের খবরও শোনা যায়। ইফতার পার্টির সঙ্গে সেহরি পার্টিও যোগ হয়েছে। উৎসবের মতো তা শহর ছাড়িয়ে এখন গ্রামেও। এ নিয়ে বড়াই-বাহাদুরির কায়কারবারও চলছে। নাগরিক জীবনে বাজারি ইফতারি এখন ঘরে ঘরে। রসনার পালে বাতাস দেয়া বাহারি বিজ্ঞাপনও দেখা যাচ্ছে।

 

এগুলোতে মুখরোচক-মনকাড়া শব্দের ছড়াছড়ি। এখানে আয়োজন-বিনিয়োগ, ব্যাপক। ভোগচর্চার সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোও। ইফতারের নামে পার্টির সমাবেশ। সেখানে বিভিন্ন দল, ধর্ম-বর্ণের প্রতিনিধিদেরও দেখা মেলে। এগুলো অনেকটাই সর্বজনীন ইফতার পার্টির মতো। আলিসান প্যান্ডেল বানিয়ে বা মিলনায়তন ভাড়া করে ইফতার পার্টির এ আয়োজনে খরচ অনেক।

 

অনাথ, এতিম, শিশু-কিশোর, প্রতিবন্ধী, আলেম-ওলামা, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, কূটনীতিক, পেশাজীবী, ব্যবসায়ী, সুশীল ইত্যাদি কাতারে গোটা মাসে ইফতার পার্টির নামে নিজেদের দৃশ্যমান রাখার ভালো ওপায়। ছোট দলগুলোও সামর্থ্য মতো যদ্দূর পারে করে। পিছিয়ে থাকে না বাম-আধা বামরাও। টুপি মাথায় দিয়ে আতর-লোবানে তাদের অগ্রযাত্রা কখনো কখনো রোজাদারের চেয়েও বেশি।

 

বড় বাপের পোলায় খায়, ছোট খালুর আলুসা, শাহী জিলাপি, কিসমত আলীর বাদাম শরবত, আবাল মিয়ার লাবাং, সুলতানের কলিজা ভুনা খাওয়া ও খাওয়ানোর প্রতিযোগিতা ঢাকায় অবস্থানকারী বিভিন্ন জেলা-উপজেলার মানুষও। এর মধ্য দিয়ে ইফতারকে মোটামুটি সংস্কৃতির পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে।

 

ইফতার পার্টি শব্দটির আবেদনও ব্যাপক। ধীরে ধীরে সেহরি পার্টিও জেঁকে বসার লক্ষণ আছে। ঢাকার বিত্তশালীদের মধ্যে সপরিবারে রেস্তোরাঁয় গিয়ে পার্টির আমেজে সেহরি খাওয়ার প্রতিযোগিতা রয়েছে অনেক দিন থেকে।

 

দেশভেদে রোজা সংস্কৃতিতে কিছুটা ভিন্নতা থাকলেও সংযমের শিক্ষায় তফাৎ নেই। আবার ইফতারে ভোজ-ভোজনের বাতিক কেবল বাঙালির নয়। ইফতার আয়োজনের ব্যাপকতা ও প্রতিযোগিতা রয়েছে আরো কিছু দেশে। রয়েছে বিশ্ব রেকর্ডও। বিশ্বের সর্ববৃহৎ ইফতার আয়োজনের জন্য গ্রিনেস বুকে সর্বশেষ নাম উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের গুরুত্বপূর্ণ শহর দুবাইর।

 

২০১৮ সালে রমজানে দুবাই পুলিশের আড়াইশত কর্মকর্তার অর্থায়নে স্থানীয় কয়েকটি রেস্টুরেন্টের সহযোগিতায় ১৮ হাজার শ্রমিককে ইফতার করানো হয়। ওই ইফতারের সারিটি হয়েছিল প্রায় ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ ইফতার টেবিল হিসেবে এই রেকর্ডকে আমলে নিয়েছে গিনেজ কর্তৃপক্ষ।

 

এর আগের বছর ২০১৭ সালের রমজানের প্রথম শুক্রবার লেবানের রাজধানী বৈরুতের ওয়াটারফ্রন্টে ৫ হাজার মানুষের দীর্ঘ সারিবদ্ধ ইফতারের রেকর্ড করে আজিয়াউন নামের একটি সংস্থা। এসব খবরের নিউজ ভ্যালু আছে। কিন্তু ধর্মের শিক্ষার সঙ্গে যায় না।

 

ধর্মীয় প্রকৃত শিক্ষার অভাব ও মন্দ চর্চার সুযোগে কেবল দেশীয় নয়, ভিনদেশিরাও রমজানকে বাণিজ্যিক মৌসুম করতে ছাড়ছে না। রমজানে বাংলাদেশ বিশ্বের অনেক দেশেরই বাণিজ্যিক টার্গেট। চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যযুদ্ধের মতো উত্তেজনা না থাকলেও বাংলাদেশের বাজার ধরতে এসব দেশ কোমর বেঁধে নামে।

 

ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, আর্জেন্টিনা, ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আলজেরিয়া, সৌদি আরব, তিউনিসিয়া, মিসর, কাতার, ওমান কে তা হাতছাড়া করে? ছোলা, মটর ও মসুর ডাল, সয়াবিন ও পাম তেল, চিনি, খেজুরের বড় সাপ্লায়ার তারা। খেজুর ঘুরেফিরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর আয়ত্বে। ছোলার বেশির ভাগ আসে অস্ট্রেলিয়া থেকে।

 

বাংলাদেশে ছোলার মোট বার্ষিক চাহিদা ২ লাখ টন। এর অর্ধেকের বেশি ১ লাখ ২৫ হাজার টনের মতো লাগে সংযমের মাসে। কয়েক দিন আগেও ছোলার দাম ছিল ৬০ টাকা কেজি। এখন ৮০ টাকার বেশি। রোজা শুরু হলে তা আরো বেড়ে এক শতে ওঠার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।

 

অস্ট্রেলিয়ার মানুষ ছোলা তেমন খায় না। এটি সেখানে ঘোড়ার খাদ্য। চাহিদার কারণে ঘোড়ার খাদ্যই এখানে উচ্চদরের পণ্য হয়ে যায়। চাহিদা আর সাপ্লাইর এটিই সূত্র। একসময় বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা রোজার পণ্য আমদানির জন্য খুঁজতেন নানা মাধ্যম। ধরতেন নানা মধ্যস্থতাকারী। দিন পাল্টে গেছে। এখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরবরাহকারীরাই বাংলাদেশে ঘুর ঘুর করেন।

 

অফিস খুলে খাস এজেন্ট নিয়োগ করেন। এর আলোকে গজায় সিন্ডিকেট। লতি, শুঁটকি, ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস কোনোটাই এর বাইরে নয়। চাহিদামতো একটির দাম বাড়লে, কেবল সমগোত্রীয় নয়, অন্য সব পণ্যের দামই বাড়ে। বাণিজ্যের এ ঘনঘটা এখন আর আজব নয়, তামাশাও নয়।

 

তবে গায়ে পড়ে শিকার হওয়ারও দরকার করে না। সংযমের প্রকৃত শিক্ষা চর্চা হলে এ বাণিজ্যিক দৌরাত্ম্য থেকে রক্ষা মেলার ওপায়ও থাকে।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version