সহায়তা বন্ধে বিপাকে দেশ

শিপংকর শীল
সহায়তা বন্ধে বিপাকে দেশ

মার্কিন সহায়তা বন্ধ হওয়ায় দিশেহারা বিশ্বের অনেক দেশ। বিপাকে পড়েছে বাংলাদেশও। এবার সহায়তা বন্ধ করেছে সুইজারল্যান্ড। ইতোমধ্যে ব্র্যাক, আইসিডিডিআরবিসহ দেশের প্রথম শ্রেণির অনেক প্রতিষ্ঠানের শত শত কর্মচারী বেকার হতে চলেছে। অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ছে অসংখ্য পরনির্ভরশীল ছোট ছোট আকারের এনজিও। এরমধ্যে বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদে যদি এই স্থগিতাদেশ থাকে তাহলে বাজেট সাপোর্টসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।তারা বলছেন, স্বল্পমেয়াদে হলে তেমন কোনো প্রভাব না পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে প্রভাব পড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের বাজেট সাপোর্টসহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ও উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় সমস্যা হবে। এজন্য আমাদের এখান থেকেই ডিপ্লোম্যাটিক উদ্যোগ নিতে হবে। তাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে। তাদেরকে এটা বোঝাতে হবে যে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যিক সহযোগী দেশ। ফলে এখন থেকে লবিং করতে হবে।

অর্থনীতিবিদরা বলেন, গত অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশকে জনস্বাস্থ্য, শিক্ষা, খাদ্যনিরাপত্তা, পরিবেশ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে সহায়তা দিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র। সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাংলাদেশের এসব সেক্টরের স্বাভাবিক কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশ্লেষকরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই প্রান্তিক পর্যায়ের কর্মতৎপরতা চালিয়ে আসছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো। বিদেশি অর্থায়নে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষদের জন্য বিভিন্ন প্রকল্প পরিচালনা করে তারা। এসব প্রকল্পে ক্রমশ বেড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন।

বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক আইনুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা কিংবা জলবায়ু সংক্রান্ত যে প্রজেক্টগুলো আমেরিকার অর্থে চলছে, এগুলো যদি বন্ধ হয়ে যায় এই তিন মাসে তো একটা সমস্যা হবেই, যদি রিভিউর পরেও কন্টিনিউ করে সেটা কিন্তু বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্যও ব্যাপক চাপ তৈরি করবে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী এবং ছোট ছোট উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে সরাসরি আঘাত আসতে পারে।’

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য তিন মাস নিলেও, বাংলাদেশের জন্য এখনই একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

জলবায়ু বা জেন্ডারের মতো ইস্যুতে ট্রাম্পের যে অবস্থান, তাতে রিভিউর পরও এই সংক্রান্ত সহায়তার ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসার সম্ভাবনা কম। খারাপটা চিন্তা করেই প্রস্তুতি নিতে হবে। তবে, এখনই সব বন্ধ করে দিতে হবে এমন না। প্রজেক্টগুলোকে জাস্টিফাই করার জন্যও তিন মাস সময় পাওয়া গেল। এমন তথ্য বেরিয়েছে বিবিসি বাংলার প্রতিবেদনে।

এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ মোহাম্মদ শাহান বলেন, এই স্থগিতাদেশ খুবই গুরুত্ব বহন করে। এই আর্থিক সহায়তা মূলত সার্ভিস ডেলিভারি, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বার্থে ব্যয় হয়। এই স্থগিতাদেশের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ দুই ধরনের প্রভাব রয়েছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে যে প্রকল্পগুলো চালু আছে তার যে প্রভাব বা ক্ষতি তা পরিমাপ করা যাবে না। কর্মকর্তা-কর্মচারী থেকে শুরু করে সুবিধাভোগী তথা বাংলাদেশই এর ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

গত ২৬ জানুয়ারি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, আমি এটার উত্তর এখন দিতে পারব না। কারণ, আমার কাছে এরকম উত্তর আসেনি। তবে এটা ইতোমধ্যে পত্রিকায় চলে এসেছে। মোটামুটি এটা প্রত্যাশিত ছিল। তিনি বলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) ৯০ দিনের জন্য সব ধরনের তহবিল বন্ধ রাখছে। তিনি (মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প) কিন্তু নির্বাচনের আগে থেকে বলছিলেন, এগুলো বিবেচনা করে নতুন করে দেখবেন। তারা বিবেচনার জন্য সময়টা নিয়েছে, এভাবে তো বলেছে। ধরে নেওয়া যায়, এ ধরনের তহবিল কমবে, এটা তো সবাই আশঙ্কা করছিল।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমরা একটা নতুন বাস্তবায়তায় আসছি। এটা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকা উচিত না। কারণ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট এসেছেন। তিনি তার যে নীতিমালা, সেগুলো যে আগে থেকে ভিন্ন, এটা সবাই জানতেন। আমাদের দেখতে হবে, আসলে শেষ অবদি কী দাঁড়ায় এবং যেকোনো পরিস্থিতি যখন সৃষ্টি হবে, তখন সেটা আমাদের ম্যাটারস বিহাইন্ডে (নেপথ্যের কারণ) বের করতে হবে; কীভাবে আমাদের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্তটি নিয়েছে সেটা বিশ্বের দুটি দেশ বাদে সকল দেশের জন্য প্রযোজ্য। তবে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সহযোগিতা তার ওপর একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। তারা এটা তিন মাস পরে রিভিউ করবে। তখন তারা কি সিদ্ধান্ত নেবে সেখানে বাংলাদেশের কী ভূমিকা থাকবে। মোট কথা এটা একটা চাপ সৃষ্টিরও কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যক্ষ ও অ-প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে থাকে। তারা বিভিন্ন সংস্থাকে সহযোগিতা করে। সে সব সংস্থা আবার বিভিন্ন দেশে উন্নয়নমূলক কার্যক্রম করে। এখন এসব কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। আবার অনেকেই তিন মাস পরে যখন কার্যক্রম শুরু করবে তখন পিকআপ করার মতো অবস্থায় নাও থাকতে পারে। এজন্য বিভিন্ন দেশ চাইবে যাতে রিভিউটা ইতিবাচক হয়। সুতরাং আমাদের এখানে ডিপ্লোম্যাটিক উদ্যোগের বিষয় আছে।

সহায়তা বন্ধ করছে সুইজার‌্যান্ড : বাংলাদেশ, আলবেনিয়া ও জাম্বিয়াÑ এই তিন দেশের জন্য উন্নয়ন সহযোগিতা বন্ধ করতে যাচ্ছে সুইজারল্যান্ড সরকার। সুইস সরকারের ফেডারেল কাউন্সিলের এক বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, সরকারের উন্নয়ন সহযোগিতা কাটছাঁটের বাস্তবায়ন করতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

যদিও অর্থায়ন বন্ধের মতো সিদ্ধান্তের প্রক্রিয়া আরও আগে থেকে শুরু করা হয়। এমন সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের জন্য বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে বলে বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন।

সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন মুখপাত্র পিয়ের-আলাঁ এল্টশিঙ্গার লিখিত এক বক্তব্যে বলেন, আগামী চার বছরের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা কর্মসূচি ধাপে ধাপে বন্ধ করা হবে এবং ২০২৮ সালের শেষে বাংলাদেশ আর সুইস উন্নয়ন সহযোগিতার অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত দেশ থাকবে না।

সুইস সরকারের সংসদের বাজেট কমানোর এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে। ২০২৫ সালের বাজেট থেকে ১১০ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ এবং ২০২৬-২৮ অর্থবছরের জন্য ৩২১ মিলিয়ন সুইস ফ্রাঁ কমানোর সিদ্ধান্ত নেয় দেশটির সরকার।গত ২৯ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বৈঠকে সুইস ফেডারেল কাউন্সিল সংসদের গৃহীত উন্নয়ন সহযোগিতার বাজেট কাটছাঁটের বাস্তবায়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানানো হয়।

বাংলাদেশ কতটা সহযোগিতা পায়? বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সুইস অর্থায়নের দিক দিয়ে একদম শীর্ষ না হলেও মোটামুটি শীর্ষ পর্যায়ের ১৫ দেশের একটি বলা যায়। সুইজারল্যান্ডের উন্নয়ন সহযোগিতার তালিকায় ২০২৩ সালে এশিয়ায় সর্বোচ্চ অর্থায়নে দখলকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল, সিরিয়া, মিয়ানমার ও আফগানিস্তানের পরে ছিল বাংলাদেশ।

বাংলাদেশে সে বছর ৩৪১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বরাদ্দ ছিল (১ সুইস ফ্রাঁ = প্রায় ১.১ মার্কিন ডলার = প্রায় ১৩৪ টাকা)। এশিয়ার বাইরে ধরলে এর চেয়ে বেশি অঙ্কে ইউরোপে ইউক্রেন, মলদোভা, ও আফ্রিকায় মালি, বুরকিনা ফাসো, সোমালিয়া ও চাদ ছিল।

অর্থাৎ ২০২৩ সালের হিসেব দেখলে সুইস অর্থায়নের অন্তত ১১২টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ ছিল ১১তম। এ তথ্য সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরের ডেভেলপমেন্ট স্ট্যাটিস্টিকস ইউনিটের।

বাংলাদেশ-সুইজারল্যান্ড সম্পর্ক নিয়ে সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র দপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বাণিজ্য ছাড়াও বাংলাদেশে টেকসই অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ধরনের উন্নয়ন কর্মসূচি পরিচালনা করে দেশটি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সামাজিক উন্নয়ন, রোহিঙ্গা সংকট, দুর্যোগ ও জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী করার মতো অনেক ক্ষেত্রেই কাজ করছে সুইজারল্যান্ড।

দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন অংশীদার হিসেবে বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেও সহায়তা করেছে সুইজারল্যান্ড। বাংলাদেশে অর্থায়ন বন্ধের ঘোষণা বাংলাদেশের জন্য সামনের দিনগুলোতে বাড়তি চ্যালেঞ্জ তৈরি করার শঙ্কা সৃষ্টি করছে।

রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, বাংলাদেশে শিক্ষা, দক্ষতা বৃদ্ধি, নারী উন্নয়ন এমন অনেক ক্ষেত্রেই সুইস সহযোগিতাটা অনেকটা ‘স্ট্রিং অ্যাটাচ’ বা শর্তসাপেক্ষ ছাড়াই হয়ে থাকে। সে জায়গায় যদি এমন সহযোগিতা কমে যায় তাহলে সেটা বাংলাদেশের জন্য চাপ বাড়াবে বা কিছুটা শূন্যতা তৈরি করবে মনে করছেন তিনি।

আমেরিকায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর যেভাবে বিশ্বব্যাপি অর্থায়ন পুনর্বিবেচনার জন্য স্থগিত করেছেন সে প্রেক্ষাপটে হুমায়ুন কবির বলেন, আস্তে আস্তে একটা প্রবণতা পরিষ্কার হচ্ছে যে বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে আগে যে উদার ব্যবস্থা ছিল বা পশ্চিমা যে উন্নত বিশ্ব তারা এটাকে যে নৈতিক মানদণ্ডের বিচারে দেখতো সেই জায়গাটা থেকে তারা সরে আসছে ধীরে ধীরে।

মন্তব্য