প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
প্রতিশ্রুতিতেই সীমাবদ্ধ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন

আলোচনার টেবিলে চলে কথার লড়াই। প্রতিবারই মেলে প্রতিশ্রুতি আর পাশে থাকার আশ্বাস। কিন্তু এই গালভরা বুলিতেই আটকে আছে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। এখন পর্যন্ত একজনকেও পাঠানো যায়নি মিয়ানমারে। রোহিঙ্গারা বলছেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদ্যোগেই ফিরতে চান নিজ ভূমিতে। প্রত্যাবাসন অনিশ্চিত হওয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে রোহিঙ্গারা, ক্যাম্পগুলোও হয়ে উঠছে অপরাধের অভয়ারণ্য।

কক্সবাজারের উখিয়ার ৩ নম্বর ক্যাম্পের প্রধান কমিউনিটি নেতা ফয়েজুল ইসলাম (৪৬)। ক্যাম্পের ছোট্ট একটি ঘরে পরিবারের ১১ সদস্য নিয়ে বসবাস। দুর্বিষহ জীবনে একে একে সাত বছর পার করার পর সন্তানদের বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুশ্চিন্তাও বাড়ছে সমানতালে। হেড মাঝি ফয়েজুল ইসলাম বলেন, আশ্রিত জীবনের সময় অনেক বেড়ে গেছে, ক্যাম্পে বসবাস করতে সমস্যা হচ্ছে। যে বাচ্চা আসার সময় চার বছর ছিল তার বয়স এখন ১২ বছর, আর যার ছিল ১২ বছর তার বয়স এখন ২০ বছর। কিন্তু ৯ হাতের ঘর বাড়েনি। তিনি বলেন, মিয়ানমারের রাখাইনে ২৪ ঘণ্টা লড়াই চলছে, মুসলমান যারা আছে তাদের মেরে ফেলছে। এখন আমাদের সেখানে যেতে বললে কিভাবে যাব? আর যদি কেউ আমাদের দেশটা শান্ত করে দিতে পারে, তাহলে আমাদের যেতে বলতে হবে না, স্বেচ্ছায় চলে যাব। মিয়ানমারের জান্তা সরকার আর আরাকান আর্মির লড়াই মনে হচ্ছে একটা নাটক। তা না হলে মিয়ানমার সরকার সন্ত্রাসীদেরকে নির্মূল করতে এতো সময় নিতো না।

শুধু ফয়জুল ইসলামই নয়; কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয়া লাখ লাখ রোহিঙ্গা ফিরতে পারছেন না মিয়ানমারে। তাদের দাবি, মিয়ানমার সরকারের টালবাহানায় ফিরতে পারছেননা নিজ ভূমিতে। ক্যাম্প-১ এর বাসিন্দা জোহার (৩৬) বলেন, ক্যাম্পে যে ঘরে থাকছি, এমন ঘরে মিয়ানমারে আমরা গরু-ছাগলও রাখিনি। বাংলাদেশেও মানুষ বেশি, আমরাও নির্যাতিত হয়ে এখানে এসেছি। মুসলমান হিসেবে বাংলাদেশ আমাদের আশ্রয় দিয়েছে। ক্যাম্প-১, ব্লক ডি-৩ এর বাসিন্দা আব্দুর রশিদ (২৪) বলেন, স্বদেশে ফিরতে পারব এই আশা তো কম। কারণ মিয়ানমারের জান্তা সরকার বেশি নির্যাতন করছে। আগেও করেছে এখনও করছে। স্বদেশে ফিরে যাবার আশা আছে কিন্তু মিয়ানমারের সরকার তো আমাদের মানছে না। ক্যাম্প-৪ এর বাসিন্দা মোহাম্মদ জাবের (২৪) বলেন, ক্যাম্পে আশ্রিত জীবনের ৮ বছর চলছে, ক্যাম্পে থাকা মানেই কষ্ট। কারণ বৃষ্টি হলে ভিজতে হচ্ছে, রোদ হলে পুড়তে হচ্ছে। এই কারণে আমাদের দেশে আমরা ফিরে যেতে চাই।

আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটসের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জোবায়ের বলেন, মিয়ানমার এক গুলিতে দুই শিকার করছে। তারা লড়াই করছে তাদের দেশ নেয়ার জন্য। তাদের এই লড়াইয়ে রোহিঙ্গাদের বিতাড়িত করছে। একই সঙ্গে ধ্বংস করছে রোহিঙ্গা কমিউনিটিকে। আরাকান আর্মি, জান্তা সরকার ও এনইউজি সবাই রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন করছে। তাই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইলে সব পারে। যেমন- কসোভো, রুয়ান্ডা, ভিয়েতনাম, বসনিয়া, আফগানিস্তান ও ইরাকে করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। আজকে রোহিঙ্গাদের জন্য কেন করতে পারবে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাইলে আমরা মিয়ানমারে ফিরতে পারব।

এদিকে স্থানীয়দের দাবি; রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন না হওয়ায় সংকট বাড়ছে। কাঁটাতার কেটে নানা উপায়ে ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছেন রোহিঙ্গারা। সেইসঙ্গে ক্যাম্পেও বাড়ছে অপরাধ; ঝরছে প্রাণও। উখিয়ার ফলিয়ারপাড়ার বাসিন্দা সাব্বির আহমদ বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে সব সময় আতঙ্কে থাকি। কারণ তারা গোলাগুলি, খুন, অপহরণ, মাদক থেকে শুরু করে এমন কোনো অপরাধ নেই তারা করছে না। কুতুপালং এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা মাসুম হোসেন বলেন, দিন যতই যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের মধ্যে অনেকেই ভয়ংকর হয়ে উঠছে। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

কক্সবাজারের পুলিশ সুপার রহমত উল্লাহ বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার জনসংখ্যা হচ্ছে পাঁচ লাখ। কিন্তু তার বিপরীতে মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা সংখ্যা ১৫ লাখ। ক্যাম্পে অনেক বিদেশি সংস্থা ও এনজিও কাজ করছে। আপাতত আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেটুকু আছে মোটামুটি ভালো আছে। কিন্তু দিনের পর দিন এটা খারাপের দিকে যাচ্ছে। তারপরও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য