সরকার বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কুইক রেন্টাল পাওয়ারসহ সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন ধরনের বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করেও সংকটের স্থায়ী নিরসন করতে পারেনি। বিদ্যুৎ ও জ¦ালানি খাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেগাপ্রকল্প গ্রহণের বিরুদ্ধে নাগরিক সংগঠন ‘তেল-গ্যাস-খনিজসম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি’সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞরা তীব্র প্রতিবাদ করলেও তাতে কর্ণপাতই করেননি তারা। বরং প্রতিবাদকারী ও সমালোচকদের যুক্তিতর্ক পদদলিত করে অপরিকল্পিত ও পরিবেশবিনাশী সেসব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের পেছনে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা হয়।
এছাড়া সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা ছাড়া স্বল্পসময়ে বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়, তা জেনেও দেশের শতভাগ গ্রামকে বিদ্যুতের আওতায় আনার স্বপ্নের বিভোর হয়ে কল্পনাবিলাসী আলোক উৎসবে মেতেছিল তখনকার সরকার। আর এই অপরিণামদর্শিতার ফল যা হওয়ার, তা-ই হয়েছে। রাষ্ট্রের টাকা অপচয় হয়েছে। কিন্তু বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ হয়নি বরং সৃষ্টি হয়েছে আমদানি নির্ভরতা। বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ভারত থেকে আসা বিদ্যুৎ সরবরাহ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে অথবা বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ¦ালানি সংকট সৃষ্টি হলে উদ্ভুত পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) হাতে তাৎক্ষণিক বিকল্প নেই। যদিও পিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ভারত থেকে সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলেও জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো উৎপাদন সক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাংলাদেশে আছে। তবে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, এগুলো চালানোর জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নিয়ে। এ ধরনের সমস্যা দেখা দিলে জ্বালানি সংকটের কারণে পিডিবি তা তাৎক্ষণিকভাবে মোকাবেলা করতে পারবে কি না, সে বিষয়ে বড় ধরনের সংশয় রয়েছে বলে মনে করছেন তাঁরা।
অন্যদিকে, নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, দেশে জ্বালানি সংকট থাকায় বিদ্যুৎ আমদানির ওপর নির্ভরতা বেড়ে চলেছে। আবার আমদানি করা বিদ্যুতের পরিমাণটাও কম নয়। তবে আমদানির ক্ষেত্রে অথবা সরবরাহ ব্যবস্থায় কোনো কারণে সংকট সৃষ্টি হলে পরিস্থিতি বেশ নাজুক হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ বা বিকল্প সরবরাহ সক্ষমতা তৈরির সুযোগ এ মুহূর্তে নেই। কারণ ভবিষ্যতে এ ধরনের সম্ভাব্য অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবেলার মতো প্রয়োজনীয় জ্বালানির বড় সংকট রয়েছে।
পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, দেশে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুতের দৈনন্দিন যে চাহিদা, তা পূরণ হচ্ছে না। এ কারণে আড়াই হাজার মেগাওয়াট আমদানি করতে হচ্ছে। তবুও লোডশেডিং করতে হচ্ছে দৈনিক গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত। বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় সাড়ে ২৭ হাজার মেগাওয়াট থাকলেও এরমধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অর্ধেক বসিয়ে রাখতে হচ্ছে। আবার জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না উচ্চ খরচের কারণে। অন্যদিকে গ্যাসভিত্তিক বৃহৎ সক্ষমতার চারটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত হলেও জ্বালানি সংকটের কারণে সেগুলো ঠিকমতো চালানো যাচ্ছে না। এসব বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মোট সক্ষমতা ২ হাজার ৭০০ মেগাওয়াট। এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্র দীর্ঘদিন বসিয়ে রাখলে সেখানকার যন্ত্রপাতি বিকল বা অকেজো হয়ে পড়ার উচ্চঝুঁঁকিও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পিডিবির (বাংলাদেশ) কাছে ভারতীয় কোম্পানি ‘আদানি গ্রুপ’ বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া পাবে। এ বিল পরিশোধের জন্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে ইতোমধ্যেই চিঠি লিখে সতর্কবার্তা দিয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। আদানি ছাড়াও ভারত থেকে দেশটির সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিদ্যুৎ-বাণিজ্য চুক্তির আওতায় আরো ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশে আনা হচ্ছে। সেখানেও বকেয়া পড়েছে। এ বিপুল পরিমাণ বকেয়ার কারণে ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বিঘ্ন সৃষ্টি এমনকি বন্ধ হয়ে পড়ারও আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুতের দৈনিক চাহিদা ১৪ হাজার মেগাওয়াট। আদানি ও জিটুজি মিলিয়ে ভারতের সঙ্গে আমদানি চুক্তি রয়েছে ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াটের; যা চাহিদার ২০ শতাংশের কাছাকাছি। চুক্তি অনুযায়ী, আদানি গ্রুপ ও জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে মোট ২ হাজার ৭৬০ মেগাওয়াট আসার কথা। তবে পিডিবির তথ্য বলছে, দেশে বিদ্যুতের গড় সরবরাহ প্রায় ১৩ হাজার মেগাওয়াট। এর মধ্যে ভারত থেকে এ সরবরাহ সর্বনিম্ন ২ হাজার ও সর্বোচ্চ আড়াই হাজার মেগাওয়াট।
কিন্তু এরই মধ্যে আদানি গ্রুপের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিদ্যুৎ বিক্রি বাবদ কোম্পানিটির পাওনা বেড়েই চলেছে। এ পরিস্থিতিকে ব্যবসা চালানোর জন্য ‘টেকসই নয়’ বলে মনে করছে আদানি গ্রুপ। বকেয়া বেড়ে যাওয়ায় পিডিবিকে জিটুজির আওতায় আনা বিদ্যুতের সরবরাহও কমিয়ে দিয়েছে দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলো। বকেয়া পরিশোধ নিয়ে সংকট আরো বাড়লে একপর্যায়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুতের সরবরাহ বন্ধও হয়ে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ধরনের পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিক সংকট মোকাবেলায় পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগের অধ্যাপক আব্দুল হাসিব চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আকস্মিকভাবে গ্রিড বিপর্যয় ঘটলে কিংবা গ্রিড থেকে বড় কোনো সক্ষমতা আউট হয়ে গেলে তা মোকাবেলার জন্য মোটা দাগে দুটি বিষয় প্রস্তুতি ও পর্যবেক্ষণ থাকতে হয়। প্রথমত, যে সক্ষমতার সরবরাহ গ্রিডে কমছে, তা পুষিয়ে নেওয়ার জন্য অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা এবং সে প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান রাখা। দ্বিতীয়ত, পাওয়ার প্ল্যান্ট নির্দিষ্ট একটি সময়ে রক্ষণাবেক্ষণে নিতে হয়। ফলে গ্রিড ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময়ই হিসাবটাও রাখতে হয়।’
ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফাইনান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ বিপুল পরিমাণ বকেয়া অর্থ এখন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ভারতের ঝাড়খন্ডের ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার গড্ডা কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ ক্রয় বাবদ শুধু আদানি গ্রুপের কাছে বাংলাদেশের বকেয়া বেড়ে ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। এ সংক্রান্ত এক বিবৃতিতে আদানি পাওয়ার বলেছে, ‘আর্থিক চাপ সত্ত্বেও আমরা বাংলাদেশে বিদ্যুতের নির্ভরযোগ্য সরবরাহ বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমরা দেশটির সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি এবং তাদের জানিয়েছি যে, পরিস্থিতি আর টেকসই পর্যায়ে নেই। কারণ আমরা একদিকে যেমন বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়ে প্রতিশ্রুতি বজায় রাখছি, অন্যদিকে তেমনি ঋণদাতা ও সরবরাহকারীদের কাছে দেওয়া আমাদের অঙ্গীকারও রয়েছে।’
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সংক্রান্ত মোট ঋণের পরিমাণ এখন ৩৭০ কোটি ডলার। অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ¦ালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানকে উদ্ধৃত করে ফাইনান্সিয়াল টাইমস জানিয়েছে, বাংলাদেশের কাছে ৮০ কোটি ডলার পায় আদানি গ্রুপ; এর মধ্যে ৪৯ কোটি ২০ লাখ ডলার পরিশোধ বিলম্বিত হয়েছে। আদানি পাওয়ারের বাইরে বাংলাদেশ জিটুজি চুক্তির আওতায় ভারত থেকে ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট আমদানি চুক্তি রয়েছে। এই বিদ্যুৎ আমদানিতেও বিপুল পরিমাণ বকেয়া রয়েছে। এমনকি ত্রিপুরা দিয়ে আসা ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির বিল পরিশোধ করতে না পারায় এরই মধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে ত্রিপুরার বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি ‘ত্রিপুরা স্টেট ইলেকট্রিসিটি করপোরেশন লিমিটেড (টিএসইসিএল)’। ভারত থেকে আমদানিকৃত বিদ্যুতের বেশির ভাগ দেশের উত্তরাঞ্চলে সরবরাহ করা হচ্ছে। ওই অঞ্চলে এ মুহূর্তে বড় সক্ষমতার তেমন কোনো বিদ্যুৎ কেন্দ্র নেই। ফলে কোনো কারণে আমদানি বিদ্যুতের সরবরাহ কমে গেলে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে সেখানে সরবরাহ অব্যাহত রাখতে হবে। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত জ্বালানির সংস্থান নেই।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) বিডি রহমত উল্লাহ বলেন, ‘গ্রিডে বড় কোনো সক্ষমতা ট্রিপ করলে বা অন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুতের সরবরাহ নিতে হলে সেগুলোর জন্য যে জ্বালানি প্রয়োজন, তা মজুদ নেই। একই সঙ্গে ভারত থেকে আমদানি বা বিদ্যুৎ সরবরাহ কমে গেলে অথবা বন্ধ হলে তার প্রস্তুতি পিডিবির এ মুহূর্তে আছে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। তিনি বলেন, এ বিষয়ে পিডিবির প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। কারণ, আদানি যেদিন থেকে ভারতীয় গ্রিডে তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহের সুযোগ পেয়েছে, তখন থেকেই বিকল্প একটা পরিকল্পনা গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়েছে।’
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য