রাজধানী ঢাকার মুখরোচক কয়েকটি খাবার আইটেমের মধ্যে কাচ্চি বিরিয়ানি, ফালুদা, লাচ্চি ও বাকরখানির নাম সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। এরমধ্যে বিরিয়ানি এসেছে মোগলদের মাধ্যমে, এটি আদি বাংলাদেশী খাবার নয়। তবে বিরিয়ানিসহ এসব খাবার আইটেমের বাংলাদেশে যাত্রা শুরু হয়েছে পুরান ঢাকা থেকে; যা বর্তমানে পুরান ঢাকার ঐতিহ্যের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যদিও এসব খাবার ঢাকার সীমানা পেরিয়ে এখন সারাদেশেই তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে।
তবে মসলাদার মোগল খাবার বিরিয়ানির বাইরে গিয়েও ঢাকায় অনেক খাবারই এখন ভোজনরসিকদের আকৃষ্ট করছে এবং খাবারগুলোর ধরনও সম্পূর্ণ বিপরীত। যেসব স্থানে বা দোকানে এসব খাবারের দেখা মেলে, সেগুলোর একটির নাম ‘জগন্নাথ ভোজনালয়’। যদি কেউ একেবারেই নিরামিষ খেতে চান, তাদের জন্য জগন্নাথ ভোজনালয় হতে পারে দারুণ একটি স্থান। এর অবস্থান তাঁতিবাজার শিবমন্দিরের কাছে, ১১০ নং হোল্ডিংয়ের ভবনটির দোতালায়। এই ভবনের নিচতলায় আছে ‘পুষ্প’ নামে একটি জুয়েলারি দোকান।
২০০৫ সালে জনৈক নিতাই পালের হাত ধরে জগন্নাথ ভোজনালয়ের যাত্রা শুরু। সেই হিসেবে এই খাবার হোটেলটির বয়স এখন ২০ বছর। নিতাই পাল কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে ২০২০ সালে মারা যান। তারপর মালিকানা পরিবর্তন হয়েছে। বর্তমানে এর তত্ত্বাবধানে আছেন অশোক কবিরাজ। তিনি গোপীনাথ ভোজনালয়েরও মালিক। এখন দুটো হোটেলই একসঙ্গে চালাচ্ছেন তিনি।
অশোক কবিরাজ জানান, জগন্নাথ ভোজনালয়ের সব আইটেম নিরামিষ। ভর্তা, ডাল, ছানা, বড়া, সয়াবিন, রসা, ধোকা। শেষপাতে পায়েস আর চাটনি। রান্নায় পেঁয়াজ ও রসুন ব্যবহার করা হয় না। তবে অন্যান্য মসলা দেওয়া হয়। একাদশীর সময় হলে, চন্দ্র তিথিতে বিশেষ খাবার পাওয়া যায়। পুষ্পান্ন (অর্থাৎ পোলাও), খিচুড়ি, সাগুদানা ভুনা, ছানার রসা, ফুলকপির রসা, পাঁচমিশালি সবজি ও শ্যামা দানার পায়েস করা হয়। একাদশীর রান্না হয় সানফ্লাওয়ার তেলে। অন্যান্য দিন সয়াবিন ব্যবহার করা হয়।
পেঁয়াজ- রসুন তো বাদই, একাদশীর রান্নায় অন্যান্য মসলাও দেওয়া হয় না। শুধু আদা আর কাঁচামরিচ দেওয়া হয়। এখানে ভর্তা পাওয়া যায় ৮-১০ রকমের। ডাল পাওয়া যায় ৩-৪ প্রকারের। শাকও পাবেন ৫ প্রকারের। হোটেলের টেবিলগুলোয় সারিবদ্ধ করে সাজানো রেকাবি (ট্রে)। সেখানে ইস্পাতের (স্টিল) ছোট ছোট বাটিতে করে সাজানো প্রায় ২০ প্রকারের নিরামিষ তরকারি। যার যে রকম প্রয়োজন, তিনি সেভাবে নিয়ে নিতে পারেন। সব তরকারির দাম ২০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ টাকার ভেতর।ভাত এক প্লেট ২০ টাকা, প্রয়োজনে ৭ টাকা করে অতিরিক্ত ভাত নিতে পারবেন। ভাত টেবিলে দেওয়া থাকে না। এটি দোকানের লোকেরাই পরিবেশন করে থাকেন। দৈনিক ২০টি পদ করা হয় এখানে। তার ভেতর রসা, লাবড়া, শুক্তো, ৫ তরকারি, ধোকা- সবই পাবেন। দোকানে বসে একসঙ্গে ৩৫-৩৬ জন খেতে পারেন।
তবে ভর দুপুরবেলায় ভিড় একটু বেশিই থাকে। দুপুর ১টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা-৪টা পর্যন্ত বেশ লোকসমাগম হয় বলে জানান অশোক কবিরাজ। রাতে ১০টা পর্যন্ত সাধারণত দোকান খোলা রাখেন। তবে ভিড় বাড়লে সেটি বেড়ে হয় ১১টা। অশোক কবিরাজ বলেন, ‘আমরা এখানে প্রতিদিন কেমন লোক খাবে, সেসব হিসাব করেই রান্না চড়াই। প্রয়োজনে খাবারে কম পড়ুক কিন্তু অবিক্রিত যেন না থাকে। এছাড়া নিরামিষ খাবার বাসি হলে দেখে বোঝা যায়। কালচে হয়ে যায়। সেটা খাওয়ার উপযোগী থাকে না এবং খরিদ্দারের টেবিলে পরিবেশন করা যায় না।
মূলত নিরামিষভোগী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কথা চিন্তা করে হোটেলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। তবে সব ধর্মের মানুষের জন্যই এটি উন্মুক্ত। এখানে দূর-দূরান্ত থেকেও অনেকেই খেতে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও বর্তমানে মানিকগঞ্জ জেলা খাদ্য কর্মকর্তা কাজী সাইফুদ্দীন অভি এখানে নিরামিষ ভোজনের অভিজ্ঞতা জানালেন। তিনি বলেন, ‘জগন্নাথ ভোজনালয়ের খাবার আমার কাছে খুবই ভালো লেগেছে। ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে মাসে অন্তত দুই দিন বন্ধু ও সহপাঠীদের নিয়ে খেতে আসতেন এখানে। তিনি বলেন, খাবারের পরিমাণ ও মান হিসেবে দাম বেশ সাশ্রয়ী বলা যায়। এলাকাটা একটু ঘিঞ্জি, তবে দোকানের পরিবেশ ছিমছাম।’
তাঁতিবাজারের একটি বুলিয়ন সেন্টারের (স্বর্ণ ও রৌপ্যালংকার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান) কর্মী ও স্থানীয় বাসিন্দা লাল্টু বণিক জানালেন, তিনি প্রায়ই এখানে খেতে আসেন। এই তরুণের অভিমত, ‘এখানে আপনি পেট ভরে খেতে পারবেন অল্প টাকায়। অন্তত ৮০ টাকা খরচ করলেই ৩-৪টি আইটেম দিয়ে আরামে খেতে পারবেন। রান্না তৃপ্তিদায়ক। এজন্য মাঝে মাঝেই আসি।’অশোক কবিরাজ জানান, পূজার সময় এখানে খুবই ভিড় হয়। বন্ধের দিনেও লোক বেশি হয়। শুক্রবার ছুটি থাকায় অনেকে আসে। অন্যান্য দিনেও শাঁখারিবাজার, তাঁতিবাজার, ইসলামপুর, নবাবপুর থেকে মানুষ আসে। এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তো আসেই। তিনি বলেন, ‘দূর-দূরান্ত থেকে কেউ যদি আসতে না পারেন, সেক্ষেত্রে আছে হোম ডেলিভারির ব্যবস্থা। ফুডপান্ডা, পান্ডা গোর মতো অ্যাপগুলো থেকে অর্ডার করে পেতে পারেন খাবার।’
করোনায় আগের মালিক নিতাই পালের মৃত্যুর পর এই হোটেলের দায়িত্ব গ্রহণ মোটেও সহজ ছিল না অশোক কবিরাজের জন্য। তখন হোটেল বন্ধও রাখতে হয়েছিল অনেক দিন। এখন দোকানের সার্বিক অবস্থা নিয়ে তিনি সন্তুষ্ট। দোকানে এখন কর্মচারি আছেন ২০ জনের মতো। রান্না, কাটা-বাছা, পরিবেশনা সবকিছুই তারা করেন। অশোক কবিরাজ জানান, প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই আইটেমের বৈচিত্র্য ও মানের কারণে জনপ্রিয় ছিল দোকানটি। এখনও সেই মান অটুট আছে। এছাড়া মসলা, তেল-চর্বিবিহীন নিরামিষ খাবারগুলো স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো।
অশোক আরো বলেন, ‘এখানে আপনি যেটাই খান, তৃপ্তি পাবেন। আইটেমগুলো থেকে টক-ঝাল-মিষ্টি-তেতো সব স্বাদের খাবার পাবেন। যেটা যেরকম পছন্দ, যতটুকু পছন্দ নেবেন। টেবিলে সব দেওয়াই থাকে, পছন্দমতো তুলে নেবেন। ঢাকার অনেক জায়গায় সুস্বাদু পোলাও-বিরিয়ানি পাওয়া যায়। কিন্তু যদি বাড়ির রান্নার মতো শান্তি করে একটু ভাত-তরকারি চান বা বাঙালিয়ানা রান্না খেতে চান, তবে এখানে চলে আসবেন। খেয়ে তৃপ্তি পাবেন।’
ভোরের আকাশ/মি
মন্তব্য