-->

পুরোপুরি বন্ধ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র

তবে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের খামখেয়ালিপনা দায়ী

শাহীন রহমান
পুরোপুরি বন্ধ পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র

শাহীন রহমান: তিন বছর আগে উৎপাদনে আসে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। কয়লা সংকটে মে মাসের শেষদিকে কেন্দ্রটির একটি ইউনিট বন্ধ করে দেয়া হয়। পাশাপাশি অন্য ইউনিটটিরও উৎপাদন কমানো হয়। অবশেষে কয়লা সংকটের কারণে সোমবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি। এর ফলে সারা দেশে লোডশেডিং বেড়ে গেছে।

 

তবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মকর্তারা বাংলাদেশ ব্যাংকের খামখেয়ালিকে দায়ী করেছেন। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, কেন্দ্রটির কয়লা আমদানির জন্য ডলার চেয়ে বারবার বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ আবেদন জানানো হয়েছে। কিন্তু তারা বিদ্যুৎ বিভাগের এই আবেদন আমলেই নেননি।

 

প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানান, প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানিবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধরী, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ, বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব হাবিবুর রহমান, পিডিবি চেয়ারম্যান মাহবুবুর রহমান এবং বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালন এএম খোরশেদুল আলম দফায় দফায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করে ডলার সংকটের বিষয়টি তুলে ধরেছেন।

 

কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টিকে হালকাভাবে নিয়েছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, চীন বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য আর কয়লা আমদানি করে দিতে না চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের সংস্থান করে দিতে সম্মত হয়। ততক্ষণে কেন্দ্রটির জন্য কয়লা ফুরিয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার সংকট মেটানোর বিষয়টিতে আগে গুরুত্ব দিলে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রটি বন্ধ হতো না।

 

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্র বলছে, এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা আমদানি করে চীনা অংশীদার প্রতিষ্ঠান সিএমসি। ছয় মাসের বিলম্বিত পরিশোধ ঋণপত্রের সুবিধায় সিএমসি পায়রাকে কয়লা এনে দেয়। কিন্তু সিএমসির ছয় মাসের দেনা নয় মাসেও শোধ করতে পারেনি পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে শুধু কয়লার দাম ৩০০ মিলিয়ন ডলার বকেয়া পড়ে।

 

এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনা বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এরপরই বাংলাদেশ ব্যাংক নড়েচড়ে বসে। তারা কেন্দ্রটির বকেয়া ৩০০ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১০০ মিলিয়ন ডলার দিতে সম্মত হয়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ডলার সংকটে গত এপ্রিলে কোনো এলসি খুলতে না পারায় মে মাসে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জন্য কোনো কয়লা আসেনি। এমন অবস্থায় সোমবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিটে বন্ধ হয়ে যায় দেশের সবচেয়ে বড় তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা।

 

পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকৌশলী জোবায়ের আহমেদ জানান, বন্ধ হয়ে যাওয়ার আগে সোমবার সকাল ১০টার দিকেও ৪০০ টনের মতো কয়লা মজুত ছিল। এই পরিমাণ সোমবার দুপুর ১২টা ১০ মিনিট চলার পর বন্ধ হয়ে যায়।

 

দেশে কিছুদিন ধরেই আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল সবচেয়ে বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র পায়রা বন্ধ হচ্ছে। গত শনিবার বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাভারে এক অনুষ্ঠানে জানান, ৫ জুন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। তিনি বলেন, জ্বালানি সংকটের কারণে পায়রা তাপবিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি ইউনিট বন্ধ রয়েছে। ৫ জুনের পর পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। আমাদের এলসি খুলতে দেরি হয়েছে। পাশাপাশি অন্যান্য বিষয়গুলোও ছিল। কয়লা আমদানি করতে আরো অন্তত ২০-২৫ দিন সময় লাগবে।

 

তিনি বলেন, কয়েকটা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে লোডশেডিং বেড়েছে। প্রায় ১৭০০ মেগাওয়াট লোডশেডিং চলছে। এতে দুর্ভোগ হচ্ছে। এ কারণে আমরা দুঃখিত।

 

এদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দেশে লোডশেডিং বেড়েছে বহুগুণ। এ মুহূর্তে লোডশেডিং থেকে মুক্তির জন্য কোনো সুখবর দিতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে সরকারের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে আরো দুই সপ্তাহ সময় লাগবে বলে জানানো হয়েছে। এ সময়ের জন্য সবাইকে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হওয়া ও ধৈর্য সহকারে পরিস্থিতি মোকাবিলার কথা বলা হয়েছে।

 

তবে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, নতুন করে কয়লা এলে চলতি মাসের শেষ নাগাদ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি আবার উৎপাদনে ফিরতে পারে। তখন লোডশেডিং পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হতে পারে। এর আগে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি নিয়ে কেউ সুখবর দিতে পারছে না।

 

পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, কয়লা আসতে অন্তত ২৫ দিন সময় লাগতে পারে। সে হিসাবে জুনের শেষ সপ্তাহে আবার বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে। কয়লা আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। আসছে ১২ জুন জাহাজে কয়লা তোলার কথা।

 

বিসিপিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালন এএম খোরশেদুল আলম বলেন, বকেয়ার ১০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এতে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর আস্থা রেখে কয়লা সরবরাহ শুরু করতে যাচ্ছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। যত দ্রুত কয়লা আনা যায়, তার চেষ্টা চলছে।

 

বিসিপিসির কর্মকর্তারা জানান, বেশ কিছুদিন ধরে এই কেন্দ্র দিনে গড়ে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করে আসছিল। কয়লা না থাকায় গত ২৫ মে কেন্দ্রের একটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ হয়। এরপর ৬৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বাকি ইউনিট থেকে দিনে ৩০০ থেকে ৬২০ মেগাওয়াট করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হচ্ছিল। এভাবে ২ জুন পর্যন্ত চালানোর কথা ছিল। তবে উৎপাদন কমিয়ে দুদিন বাড়তি চালানো হয়। সোমবার থেকে তাও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়।

 

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) কর্মকর্তারা বলেন, তিন বছর ধরে পায়রা থেকে বিদ্যুৎ আসছে। আগে এক দিনের জন্যও বিদ্যুৎ আসা বন্ধ হয়নি। দেশের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্র কয়লার অভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উৎপাদন অনেক কমে যাবে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা ও উৎপাদনের মধ্যে বড় পার্থক্য তৈরি হবে। এ কারণে লোডশেডিং বাড়তে পারে। এমনিতেই গ্যাসের অভাবে এখন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না।

 

তারা জানান, দেশের এখন মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রায় ১০ ভাগই এককভাবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আসে। কেন্দ্রটি সংকটের মধ্যে প্রতিদিনই ফুল লোডে অর্থাৎ ১ হাজার ২৪৪ মেগাওয়াট ক্ষমতায় বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে।

 

এদিকে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের খবরে সারা দেশে লোডশেডিং আতঙ্ক তৈরি হয়েছে। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) দেশের সব উপজেলায় মাইকিং করে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার জন্য সাধারণ মানুষকে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে অনুরোধ করছে। লোডশেডিং পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষকে তারা শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়েছে।

 

প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলেন, দিনের বেলা চাহিদার অর্ধেক বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। রাতে আরো কম। গড়ে তিন ভাগের এক ভাগ বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version