-->

এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে যুগান্তকারী অর্জন

মো. রেজাউর রহিম
এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে যুগান্তকারী অর্জন

মো. রেজাউর রহিম: করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী মন্দা এবং দেশে জ্বালানি ও অন্যান্য সংকটের মধ্যেও দেশের অবকাঠমোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী উন্নয়ন কর্মকান্ড এগিয়ে চলেছে। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশ বিনির্মাণে সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এবং ২০৩০ সালের মধ্যে পরিপূর্ণ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের ক্ষেত্রে চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে। গত এক দশকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে দেশে যুগান্তকারী অর্জন সাধিত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে।

 

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশকে স্বনির্ভর ও উন্নত দেশে রূপান্তরের লক্ষ্যে বেশ কিছু মেগা প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে। জানা গেছে, ২০০৯ সালে দেশের অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে ৯টি মেগা প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। গত নভেম্বর মাস পর্যন্ত ফাস্ট ট্র্যাক প্রকল্পের অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে।

 

অন্যগুলোর মধ্যে তিনটি কাজ ৮৭ শতাংশের ওপরে এবং পাঁচ প্রকল্পের কাজ অর্ধেকের বেশি শেষ হয়েছে। দেশকে বিদ্যুৎ খাতে স্বনির্ভর করতে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ। এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯২ কোটি টাকা। প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতির হার প্রায় ৫১ শতাংশ।

 

এছাড়া চলতি মাসেই চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু টানেল চালু হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রকল্পের ৯৫ শতাংশের ওপরে সম্পন্ন হয়েছে। আর আগামী জুন মাসে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্পের কাজ শেষ হচ্ছে। এছাড়া আগামী অক্টোবরে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল চালু হবে। এর আগে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় চালু হয়েছে মেট্রোরেল। পাশাপাশি পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্প এবং যমুনা নদীর ওপর সড়ক সেতুর সমান্তরালে আলাদা রেলসেতুর কাজও দ্রæতগতিতে এগিয়ে চলেছে।

 

তবে করোনার কারণে কিছুটা বিলম্বিত হয়েছে এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ। ইতোমধ্যে গত ২৫ জুন দেশের বৃহৎ অবকাঠামোগত প্রকল্প পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। এ সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের নতুন দিগন্ত উন্মেচিত হয়েছে। এছাড়া বাস্তবায়িত হচ্ছে পদ্মা সেতুতে রেলসংযোগ প্রকল্প। যার নির্মাণ কাজ ২০২৪ সালের জুনে শেষ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত এ প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ২৬ হাজার ৩২ কোটি ৪০ লাখ টাকা।

 

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এছাড়া ৫১ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা ব্যয়ে কক্সবাজারের মাতারবাড়ীতে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ চলছে। গত নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পটিতে ব্যয় হয়েছে ২৯ হাজার ৭৯ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পাশাপাশি বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে বাগেরহাটের রামপালে ১৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ।

 

এছাড়া পটুয়াখালীর পায়রায় গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের কাজও এগিয়ে চলেছে। যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়নে পদ্মা সেতু, যমুনা রেলসেতু, পদ্মা নদীর ওপর রেল সংযোগের পাশাপাশি সারা দেশের রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে অভ‚তপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে গত এক দশকে। কক্সবাজার ও রামু-মিয়ানমার সীমান্তবর্তী ঘুমধুম পর্যন্ত সিঙ্গেল লাইন ডুয়াল গেজ ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলছে। পাশাপাশি সারা দেশকে রেল যোগাযোগের আওতায় আনতেও কাজ করছে সরকার। আর মেগা প্রকল্পের বাইরেও নিজস্ব অর্থায়নে সারা দেশে নির্মিত ছোট-বড় একশ ব্রিজ ও একশ সড়ক-মহাসড়ক চালুর মধ্য দিয়ে দেশে যোগাযোগ ক্ষেত্রে অভ‚তপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে।

 

ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার দেশের প্রথম পাতাল রেল নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পাশাপাশি এসব প্রকল্পের মাধ্যমে উন্নয়নের মাইলফলকে যুক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। এছাড়া ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ও ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং ডলার সংকটকে অনেকটা চাপমুক্ত করেছে।

 

এছাড়া সম্প্রতি সংকট মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশের জন্য ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে অনেকটাই স্বস্তিদায়ক অবস্থায় ফিরেছে দেশের অর্থনীতি। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, দেশের অর্থনীতির ভিত শক্তিশালী হওয়ায় আইএমএফ বাংলাদেশকে এ ঋণ দিচ্ছে। এছাড়া আইএমএফের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতাও বাংলাদেশের রয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

এদিকে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে বিভিন্ন সংকট সত্তে ও দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি অব্যাহত রয়েছে। অবশ্য গত এক দশকে দেশে প্রবৃদ্ধির ধারা ইতিবাচক হওয়ার পর ২০২০ সাল থেকে করোনা পরিস্থিতি এবং ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে প্রথমে কিছুটা শ্লথ হলেও বর্তমানে সে অবস্থারও উত্তরণ ঘটেছে।

 

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি ২০২৬ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে জানান, মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীতের পর সম্ভাব্য সমস্যা মোকাবিলায় ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয়, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন সংক্রান্ত একটি জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়েছে। এলডিসি উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বাণিজ্যিক সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ, পিটিএর মতো বাণিজ্য সুবিধা সংবলিত চুক্তির চেষ্টাও করছে সরকার।

 

এ ব্যাপারে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে অবকাঠামোগত উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ। দেশের চলমান অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বিশেষ করে রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, মাতারবাড়ী প্রকল্প, পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প, পায়রা বন্দরের মতো গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হবে।

 

তিনি বলেন, উন্নয়নের পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন এবং দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধের পাশাপাশি বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন ও দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা জরুরি। উন্নত দেশ বিনির্মাণে এ বিষয়গুলোর দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

উল্লেখ্য, আগের বছরগুলোতে ধারাবাহিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর করোনার কারণে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৪৫ শতাংশে দাঁড়ায়। অবশ্য এরপর গত ২০২১-২২ অর্থবছরে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে। এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে সারাবিশ্বে জ্বালানি তেল, গ্যাসের দাম ও সরবরাহে সংকট সৃষ্টি হওয়ায় দেশে পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত হারে বাড়তে থাকে।

 

তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্রতা সাধন ও পণ্য উৎপাদনের ওপর বাড়তি জোর দেয়ায় এবং বিদেশনির্ভরতা কমানোর পদক্ষেপ নেয়ায় দেশের সার্বিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে বিশ্বের অনেক দেশের চেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। 

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version