-->
ছয় আসনে উপনির্বাচন

৪০ প্রার্থীর মধ্যে জামানত নেই ২৬ জনের

শাহীন রহমান
৪০ প্রার্থীর মধ্যে জামানত নেই ২৬ জনের

শাহীন রহমান: দেশে ৬টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন গত বুধবার অনুষ্ঠিত হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগেই এই ছয় আসনের উপনির্বাচন ছিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বড় ধরনের অঘটন না ঘটলেও এ আসনের উপনির্বাচন বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ। এ নির্বাচনে এক দিনে ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই কম। ভোটার পড়েছে মাত্র ২৮.৪৬ শতাংশ। নির্বাচনে দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ভোট হয়েছে অনেকটা একতরফা। ফলে তাদের নির্বাচনী প্রচারের মানুষের আগ্রহ ছিল না বললেই চলে। ৪০ প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতার করলেও জামানত হারিয়েছেন ২৬ প্রার্থী।

 

বিশ্লেষকরা বলছেন, উৎসবমুখর ভোটের জন্য বড় রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ অপরিহার্য। এ ছাড়া কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বীও থাকা আবশ্যক। পছন্দের দল এবং শক্ত প্রার্থী থাকলে ভোটাররাও আগ্রহ নিয়ে ভোট দিতে আসেন।

 

সেজন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতা প্রয়োজন। নির্বাচন বিশ্লেষক ড. আব্দুল আলীম বলেন, ‘ভোটাররা ভোটে আগ্রহ হারালে নির্বাচন ও গণতন্ত্রের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হয়ে যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার পেছনে নির্বাচন কমিশনেরও দায় থাকে।’

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন সাম্প্রতিক সময়ে কোনো সংসদীয় আসনের নির্বাচনে এত কম ভোট পড়ার নজির নেই। আবার দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ৬টি আসনের উপনির্বাচনে এত কম ভোটার উপস্থিতি প্রমাণ করে, মানুষ ভোট থেকে বিমুখ হয়ে পড়ছে। মাঠে শক্ত প্রতিদ্ব›দ্বী না থাকায় ভোট হয়েছে অনেকটা একতরফা।

 

ব্রাহ্মবাড়িয়া-২ আসনে অংশ নেয়া দুজন স্বতন্ত্র প্রার্থীর মন্তব্য ‘এমন ভোট হলে আগামীতে তারা কখনো ভোটে দাঁড়াবে না।’ জাপার প্রার্থী আবদুল হামিদ ভাসানী বলেন, পাতানো নির্বাচন হয়েছে, নির্বাচনের পরেই এটি বুঝতে পেরেছি। এমন নির্বাচন হলে ভবিষ্যতে আর অংশ নেব না। ‘নিখোঁজ’ স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আহমেদ বলেছেন, কেন তিনি নিখোঁজ ছিলেন এটি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে প্রশ্ন করলেই উত্তর পাওয়া যাবে। তিনি চাপ অনুভব করায় নির্বাচন থেকে সরে গিয়েছিলেন বলেও জানান।

 

৬টি আসনের মধ্যে মাত্র দুটি আসনের নির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ ছিল। এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের নির্বাচন। সেখানে প্রাথী ছিলেন জাতীয় সংসদ থেকে পদত্যাগ করা বিএনপির সদস্য উকিল আব্দুস সাত্তার ভূইয়া। তিনি পুনরায় এ আসনে নির্বাচনে প্রার্থী হলে রহস্যজনকভাবে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ থেকে সমর্থন জানানো হয়।

 

তাদের নিজ দলীয় প্রার্থী এবং দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীকেও নির্বাচন থেকে সরে যেতে হয়েছে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একতরফাভাবে স্বতন্ত্র হিসেবে দাঁড়ানো উকিল আব্দুস সাত্তার ভ‚ঁইয়ার পক্ষে কাজ করেছেন। তাকে জেতানোর জন্য মরিয়া হয়েছেন। তবে জানা গেছে, কেন্দ্রের এমন নির্দেশে স্থানীয় আওয়ামী লীগও বেশ অসন্তুষ্ট।

 

এর বাইরে বগুড়া-৪ আসনের উপনির্বাচনে হিরো আলমের প্রচারই কেবল গণমাধ্যমের নজর কেড়েছে। এ দুটি আসনের বাইরে অন্য কোনো আসনের প্রার্থীরা আলোচনায় ছিলেন না। এ আসনের নির্বাচিত প্রার্থীর চেয়ে হিরো আলমের পরাজয়ের সংবাদটি গণমাধ্যমে গুরুত্ব সহকারে প্রচারিত হয়েছে। এর বিপরীতে নির্বাচিত প্রার্থীর প্রতি কারো কোন আগ্রহ ছিল না বললেই চলে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিরো আলম নানা কারণে আলোচিত ব্যক্তি। এছাড়াও নির্বাচনে মনোনয়ন জমা থেকে শুরু করে কোর্টের আদেশে প্রার্থিতা ফিরে পাওয়া পর্যন্ত সব খবরই গণমাধ্যম গুরুত্বের সঙ্গে প্রচার করেছে। হিরো আলম বাদে বগুড়ার দুটি আসনে বাকি ১৯ প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটের বিবেচনায় তারা সবাই ছিল দুর্বল প্রতিদ্বন্দ্বী।

 

শুধু বগুড়ার দুটি আসন নয়, ৬টি আসনের ৪০ প্রার্থীর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে ভোটারদের মধ্যে। এ কারণে নির্বাচনের দিন ভোটার উপস্থিতি ছিল একেবারেই নগণ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের মতো এভাবে একতরফা নির্বাচন নিয়ে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। তারা বলেন, এভাবে নির্বাচন থেকে ভোটার মুখ ফিরিয়ে নিলে জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব পড়তে বাধ্য।

 

মাঠপর্যায়ে ভোটের হার বিশ্লেষণ করে ইসি জানিয়েছে, ৬ আসনের উপনির্বাচনে মোট ভোট পড়েছে ২৮.৪৬ শতাংশ। এর মধ্যে বেশি ভোট পড়েছে ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে ৪৬.২৯ শতাংশ। গড়ে সবচেয়ে কম ভোট পড়েছে ব্রাক্ষণবাড়িয়া-২ আসনে, ১৬.১০ শতাংশ। বগুড়া-৪ আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ২৩.৯২ শতাংশ। বগুড়া-৬ আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ২২.৩৪ শতাংশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ৩৪.৭৯ শতাংশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে গড়ে ভোট পড়েছে ২৯.০৮ শতাংশ।

 

নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা সাংবাদিকদের বলেন, তিন কারণে উপনির্বাচনে ভোট কম পড়েছে। আসনগুলো বিএনপির দখলে থাকায় দলটির সমর্থকরা ভোট দিতে আসেননি। উপনির্বাচনে সাধারণত ভোট একটু কম কাস্ট হয় এবং এই উপনির্বাচনে সংসদ সদস্যদের মেয়াদকাল কম (৮ মাস থেকে সর্বোচ্চ ১ বছর) হওয়ায় ভোটারদের আগ্রহ কম ছিল।

 

এর আগে করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। ওই দিন ভোট পড়ার হার ছিল ৫.২৮ শতাংশ। তারও আগে ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ইভিএমের ব্যাপক প্রচারের মধ্যে ভোটারের খরা দেখেছিল ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনে। সেবার দক্ষিণ সিটিতে ২৯ শতাংশ ও উত্তরে ভোটের হার ছিল ২৫.৩ শতাংশ।

 

শুধু কম ভোটার উপস্থিতি নয়। ৪০ প্রার্থীর মধ্যে ২৬ জনই জামানত হারিয়েছেন। নির্বাচনী আইন অনুযায়ী কোনো আসনের প্রদত্ত ভোটের শতকরা ৮ শতাংশের কম ভোট কোনো প্রার্থী পেলে সেই প্রার্থীর জামানত বাজেয়াপ্ত হবে। এবারের ৬টি আসনের উপনির্বাচনে ৪০ প্রার্থীর মধ্যে ২৬ প্রার্থী কাক্সিক্ষত ভোট পাননি। ইসির দেয়আ তথ্য অনুযায়ী ৬টি আসনে মোট ভোটার ছিল ২২ লাখ ৫৪ হাজার ১৭ জন। এর মধ্যে ভোট দিয়েছেন মাত্র ৬ লাখ ৪১ হাজার ৪২০ জন। গড়ে ভোট পড়েছে ২৮ দশমিক ৪৬ শতাংশ।

 

ঠাকুরগাঁও-৩ আসনে জয় পেয়েছেন জাতীয় পার্টির হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। এ আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার ৩৩৪টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের কমপক্ষে ১৮ হাজার ৭৯২ ভোটের প্রয়োজন ছিল। ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে চারজন তা পাননি। জামানত হারানোদের মধ্যে বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির ইয়াসিন আলী পেয়েছেন ১১ হাজার ৩৫৬ ভোট, জাকের পার্টির এমদাদুল হক ২ হাজার ২৫৭, ন্যাশনাল পিপলস পার্টির শাফি আর আসাদ ৯৫৩ এবং বিএনএফের সিরাজুল ইসলাম পেয়েছেন ১ হাজার ৪১২ ভোট।

 

বগুড়া-৪ আসনে জয় পেয়েছেন জাসদের একেএম রেজাউল করিম তানসেন। এ আসনে ভোট পড়েছে ৭৮ হাজার ৫২৪টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের প্রত্যেকের ৯ হাজার ৮১৬ ভোট প্রয়োজন ছিল। নয়জন প্রার্থীর মধ্যে পাঁচজনই তা পাননি। এদের মধ্যে জাকের পার্টির আব্দুর রশিদ সরদার পেয়েছেন ৪ হাজার ৬৪, বাংলাদেশ কংগ্রেসের তাজ উদ্দীন মÐল ৩ হাজার ৫৬৭, জাতীয় পার্টির শাহীন মোস্তফা কালাম ৬ হাজার ৪৪৬, স্বতন্ত্র ইলিয়াস আলী ৮৪৮ এবং গোলাম মোস্তফা পেয়েছেন ২ হাজার ৩৯০ ভোট।

 

বগুড়া-৬ আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের রাগেবুল আহসান রিপু। এ আসনে ভোট পড়েছে ৯১ হাজার ৭৪২টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের ১১ হাজার ৪৬৮ ভোট পাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ১১ প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীর মধ্যে নয়জনই তা পাননি। জামানত হারানোদের মধ্যে স্বতন্ত্র মাছুদার রহমান হেলাল পেয়েছেন ১ হাজার ৬১৮ ভোট, হিরো আলম ৫ হাজার ২৭৪, রাকিব হাসান ১ হাজার ৪৪৯, সরকার বাদল ২ হাজার ৮১১, জাকের পার্টির মোহাম্মদ ফয়সাল বিন শফিক ৪১৭, গণফ্রন্টের আফজাল হোসেন ১৭০, জাসদের ইমদাদুল হক ইমদাদ ১ হাজার ৩৪০, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের নজরুল ইসলাম ৪৬৮ ও জাতীয় পার্টির নুরুল ইসলাম ওমর পেয়েছেন ৬ হাজার ৯৯৫ ভোট।

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনে জয় পেয়েছেন আওয়ামী লীগের মু. জিয়াউর রহমান। এ আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৪০টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের ১৭ হাজার ৬৩০ ভোট পাওয়ার প্রয়োজন ছিল। ছয়জন প্রার্থীর মধ্যে চারজন তা পাননি। জামানত হারানোদের মধ্যে স্বতন্ত্র মু. খুরশিদ আলম পেয়েছেন ১৪ হাজার ৩০৯ ভোট, জাতীয় পার্টির মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক পেয়েছেন ৩ হাজার ৬১, জাকের পার্টির গোলাম মোস্তফা ১ হাজার ৮৭০ এবং বিএনএফের নবীউল ইসলাম পেয়েছেন ১ হাজার ৪৭৩ ভোট।

 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনে বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের মো. আব্দুল ওদুদ। এ আসনে মোট ভোট পড়েছে ১ লাখ ১৯ হাজার ৬৫৮টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের ১৪ হাজার ৯৫৭ ভোট প্রয়োজন ছিল। তিনজন প্রার্থীর মধ্যে মাত্র একজন তা পাননি। তিনি হলেনÑ বিএনএফের কামরুজ্জামান খান। তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৪০ ভোট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে বিজয়ী হয়েছেন আবদুস সাত্তার ভূইয়া।

 

এ আসনে মোট ভোট পড়েছে ৬০ হাজার ১২২টি। জামানত বাঁচাতে প্রতিদ্ব›দ্বী প্রার্থীদের দরকার ছিল ৭ হাজার ৫১৫ ভোট। পাঁচজন প্রার্থীর মধ্যে তিনজনই তা পাননি। এদের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু আসিফ আলী পেয়েছেন ৩ হাজার ২৬৯, জিয়াউল হক মৃধা ৪৮৪ এবং জাকের পার্টির জহিরুল ইসলাম (জুয়েল) পেয়েছেন ১ হাজার ৮১৮ ভোট।

 

নির্বাচন কর্মকর্তারা জানান, নিয়ম অনুযায়ী কোনো প্রার্থীকে জামানত ফেরত পেতে হলে মোট বৈধ ভোটের আট ভাগের এক ভাগ থেকে অন্তত একটি ভোট বেশি পেতে হবে। এই উপনির্বাচনে যারা তা পাননি তারা জামানতের টাকা ফেরত পাবেন না।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version