-->

প্রথমবারের মতো সরকারের নির্বাহী আদেশে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম

মো. রেজাউর রহিম
প্রথমবারের মতো সরকারের নির্বাহী আদেশে বাড়ছে বিদ্যুতের দাম

মো. রেজাউর রহিম: দেশে প্রথমবারের মতো সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ছে। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের খুচরা দাম ইউনিট প্রতি ১৯ পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। ১ জানুয়ারি থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হবে। একই সঙ্গে এখন থেকে প্রতি মাসে বিদ্যুতের খুচরা দাম নিয়মিত সমন্বয় করবে সরকার।

 

বৃহস্পতিবার সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিগগির এ সংক্রান্ত আদেশ (প্রজ্ঞাপন) জারি করা হবে বলে জানা গেছে।

 

বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, সরকার নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়িয়েছে। বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো-কমানোর জন্য সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) আইন সংশোধন করে। দাম বাড়ানোর বিষয়টি নিশ্চিত করে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিবিষয়ক প্রজ্ঞাপন রাতে প্রকাশ করা হবে।

 

কত শতাংশ দাম বাড়বে, তা প্রজ্ঞাপনেই জানানো হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর জন্য বিইআরসিতে থাকা গণশুনানির অপেক্ষায় থাকা আবেদনের বিষয়ে সচিব বলেন, সরকারের এই দাম বাড়ানোর পর বিইআরসির আর দাম বাড়ানোর প্রয়োজন নেই।

 

বিদ্যুৎ বিভাগের একটি সূত্র জানায়, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ইউনিট প্রতি বাড়বে ১৯ পয়সা করে। এই প্রথম বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) গণশুনানির পরিবর্তে সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম গ্রাহক পর্যায়ে ইউনিট প্রতি ১৯ পয়সা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হলো।

 

এর আগে রোববার বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ওপর গণশুনানির আয়োজন করে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কারিগরি কমিটি। তাতে বিদ্যুৎ বিতরণকারী ছয়টি প্রতিষ্ঠান-সংস্থা দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব উত্থাপন করে। ওই শুনানিতে বিদ্যুতের দাম ১৫.৪৩ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছিল বিইআরসির কারিগরি কমিটি। তবে তাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নয়, প্রথমবারের মতো সরকারের নির্বাহী আদেশেই বিদ্যুতের দাম বাড়ছে।

 

জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারি মাসে বিদ্যুতের পাইকারি ও খুচরা দাম একসঙ্গে বাড়ানো হয়। তখন পাইকারি পর্যায়ে প্রতি ইউনিটের দাম ৫ টাকা ১৭ পয়সা নির্ধারণ করা হয়। আর খুচরা পর্যায়ে দাম ৫ টাকা ৬৪ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছিল। অবশ্য গ্রাহককে এ দামের সঙ্গে ভ্যাট, সার্ভিস চার্জসহ আরো বাড়তি দাম পরিশোধ করতে হচ্ছে। গত এক যুগে দেশে বিদ্যুতের দাম বেড়েছে নয়বার।

 

এ সময় পাইকারি পর্যায়ে ১১৮ শতাংশ ও গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ বেড়েছে বিদ্যুতের দাম। সবশেষ দাম বাড়ানো হয় ২০২০ সালের ফেব্রæয়ারিতে, সে সময় বিদ্যুতের দাম পাইকারি ও গ্রাহক এই দুই পর্যায়েই বাড়ানো হয়, যা ওই বছরের মার্চ থেকে কার্যকর হয়। ওই সময় পাইকারি পর্যায়ে ৮ দশমিক ৩৯ শতাংশ বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। একই সময়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানো হয় ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। তখন প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম গড়ে ৩৬ পয়সা বেড়ে ৭ টাকা ১৩ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।

 

উল্লেখ্য, গত ২৮ নভেম্বর মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বিশেষ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নয়, সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম পুনর্নির্ধারণ করতে পারবে এমন বিধান রেখে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’-এর খসড়ার চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়া হয়।

 

মন্ত্রিপরিষদে ‘বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২২’-এর খসড়ার চ‚ড়ান্ত অনুমোদন দেয়ার কথা উল্লেখ করে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছিলেন, আমাদের এখানে বিইআরসি বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম সমন্বয় করে। কিন্তু বিইআরসির কিছু কিছু জায়গায় প্রবলেম হয়, যেমন ৯০ দিন পর্যন্ত তারা সিদ্ধান্ত না দিয়ে থাকতে পারে। কারণ আইনে বলা আছে বিইআরসি ৯০ দিনের মধ্যে এগুলো সব শুনানি নিয়ে সিদ্ধান্ত দেবে। অনেক সময় সরকারের জরুরি প্রয়োজনীয়তা আসে।

 

এছাড়া অনেক সময় বিইআরসি ঠিকভাবে দাম সমন্বয় করতে পারে না। বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকারও যেন তা নির্ধারণ করতে পারে, এ জন্যই প্রস্তাবিত এ সংশোধনী মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদন দিয়েছে। মন্ত্রণালয় কী এটি যেকোনো সময় দাম সমন্বয় করতে পারবে- সাংবাদিকরা জানতে চাইলে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব তখন আরো বলেছিলেন, বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যেমন এখন ধরুন ৯০ দিন সময় নিয়ে বিইআরসি শুনানি নেন।

 

একটা ইমার্জেন্সি এলো, আবার অনেক সময় দাম কমে গেল কিন্তু বিইআরসি ৯০ দিন ধরে দাম কমায়। সরকার তখন হস্তক্ষেপ করে একটা নোটিফিকেশন দিয়ে দাম কমিয়েও আনতে পারবে। তবে স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে দাম সমন্বয়ের কাজ বিইআরসিই করবে, আর শুধু বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার এক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে বলে জানান তিনি।

 

বিইআরসি অধ্যাদেশ সংশোধনের পর এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা পায় সরকার। ওই অধ্যাদেশের আওতায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দিল বিদ্যুৎ বিভাগ। বিইআরসির পরিবর্তে এই প্রথম সরকারের নির্বাহী আদেশে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলো। বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, সরকার নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে চায়। তবে বিশ্ব ব্যাপী জ্বালানি তেল ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে দাম সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় মূল্য সমন্বয় করা হয়েছে।

 

জানা গেছে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) দেশে বিদ্যুতের একক পাইকারি বিক্রেতা। বিপিডিবির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনে গ্রাহক বা খুচরা পর্যায়ে বিতরণ করে দেশের পাঁচটি কোম্পানি। এগুলো হলো ডেসকো, ডিপিডিসি, আরইবি, নেসকো ও ওজোপাডিকো। এছাড়া বিপিডিবি পাইকারির পাশাপাশি দেশের কিছু এলাকায় সরাসরিও বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে।

 

এদিকে, বর্তমানে এমনিতেই দেশের মানুষ নিত্যপণ্যের মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির কারণে দুর্বিষহ অবস্থ্য়া পড়েছে। সাংসারিক ব্যয় সামলাতে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এ অবস্থায় বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষ আরো ভোগান্তিতে পড়বে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ব্যাপারে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে বিদ্যমান মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতি আরো বাড়বে, যা জনগণের জন্য বাড়তি ভোগান্তি সৃষ্টি করবে।

 

তিনি বলেন, খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে পণ্যমূল্য আরো বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। এছাড়া খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ফলে মানুষের জীবনযাত্রার খরচ বৃদ্ধির পাশাপাশি বাড়তি দুর্ভোগ সৃষ্টি হবে। বারবার দাম না বাড়িয়ে বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস, অপচয় এবং অনিয়ম বন্ধে সরকার কার্যকর ব্যবস্থা নিলে জনদুর্ভোগ অনেকাংশে কমবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

 

বিশ্লেষকদের মতে, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ফলে পণ্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধিসহ মানুষের জীবনযাত্রায় বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version