গাজীপুরের টঙ্গীর তুরাগ তীরে আজ শুক্রবার থেকে শুরু হচ্ছে ৫৬তম বিশ্ব ইজতেমা, যা তাবলিগ জামাতের বড় আসর হিসেবে পরিচিত।
আয়োজকসংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আজ ফজরের নামাজের মাধ্যমে ইজতেমার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। ইজতেমায় যোগ দিতে মঙ্গলবার থেকেই মাঠে আসতে শুরু করেছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মুসল্লিরা। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা নাগাদ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে ইজতেমা মাঠ। ঘন কুয়াশা আর জেঁকে বসা শীতের মধ্যেই টঙ্গীর তুরাগ তীরে ঢল নেমেছে মুসল্লির। এদিকে ইজমেতায় যোগ দিতে আসা মুসল্লিদের কারণে রাজধানী ও আশপাশ এলাকায় বৃহস্পতিবার থেকেই তীব্র যানজটের কবলে পড়েছে।
মহাখালী থেকে উত্তরা পর্যন্ত সড়কে তীব্র যানজটে নাকাল হতে হয়েছে যাত্রীদের। এদিন ভোর থেকেই ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় তীব্র যানজট শুরু হয়। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মহাখালী, রামপুরা এবং মিরপুরের কালশী পর্যন্ত গিয়ে ঠেকে সেই জট। সকাল থেকে তীব্র যানজটে অফিসযাত্রী এবং শিক্ষার্থীদের পড়তে হয় বিপাকে। গন্তব্যে পৌঁছাতে তাদের অপেক্ষা করতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
মহাখালীর ট্রাফিক পুলিশের পরিদর্শক (টিআই) মো. সালাউদ্দিন বলেন, ভোররাত থেকেই বিমানবন্দর সড়কের দিকে যানবাহনের গতি কমে যায়। সকালে কোনো গাড়িই উত্তরার দিকে যাচ্ছিল না। গাড়ির জট তেজগাঁও পর্যন্ত এসে ঠেকেছে। পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, বিশ্ব ইজতেমায় যোগ দিতে দলে দলে মানুষ যাচ্ছে গাজীপুরের টঙ্গীর দিকে, তারই প্রভাব সড়কে পড়েছে। এদিকে অন্যবারের মতো এবারো বিশ্ব ইজতেমা আলাদাভাবে দুই পর্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, মাওলানা জুবায়েরের অনুসারীরা ইজতেমা পালন করবেন আজ শুক্রবার থেকে। প্রথম পর্বের ইজতেমা চলবে ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। আর সাদ কান্ধলভীর অনুসারীরা ইজতেমা করবেন জানুয়ারির ২০, ২১ ও ২২ তারিখ। জুবায়েরপন্থিরা ইতোমধ্যে ইজতেমা মাঠে পৌঁছেছেন। কেউ বাসে, কেউ ট্রাকে, আবার কেউ পিকআপভ্যানে চড়ে এসেছেন। সবার হতেই একাধিক ব্যাগ ও আনুষঙ্গিক জিনিসপত্র।
মুসল্লিরা মাঠে ঢুকছেন ভিন্ন ভিন্ন ফটক দিয়ে। মাঠে ঢুকেই নির্ধারিত জায়গায় অবস্থান নিচ্ছেন মুসল্লিরা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ সালে ৫৫তম বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হওয়ার পর করোনা মহামারির কারণে গত ২ বছর ২০২১ ও ২০২২ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয়নি। ২২ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে এবারের বিশ্ব ইজতেমার সমাপ্তি ঘটবে। এদিকে দীর্ঘ বিরতির পর ইজতেমা অনুষ্ঠিত হতে যাওয়ায় এবার মুসল্লিরাও বেশ উচ্ছ¡সিত।
ইজতেমার মাঠে আসা মুসল্লিরা জানিয়েছেন অনেক দিন পর ইজতেমা হচ্ছে। সবাই খুব আনন্দিত। তাই আগে-ভাগেই চলে এসেছি। আর আগে না এলে নিজ নিজ জায়গা পেতে কষ্ট হয়। প্রথম পর্বে ইজতেমার আয়োজকরা জানান, এ বছর বিপুলসংখ্যক সাথী ইজতেমায় অংশ নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। মঙ্গলবার থেকেই সাথীরা বাসে, ট্রাকে করে দলে দলে আসছেন। সবাইকে নিয়ে একটি সুন্দর ইজতেমা হবে।
এদিকে ইজতেমা সফল করতে আয়োজকদের পক্ষ থেকে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জেলাভিত্তিক খিত্তার তালিকাও সম্পন্ন হয়েছে। বৃহস্পতিবার মধ্যেই দেশ-বিদেশের লাখ লাখ মুসল্লি ইজতেমা মাঠে তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়েছেন। আজ শুক্রবার, আগামী শনি এবং রোববার পর্যন্ত চলবে প্রথম পর্বের এ অনুষ্ঠান। ময়দানের পশ্চিম পাশে তুরাগ নদীর পূর্বপাড়ে নামাজের মিম্বার এবং উত্তর-পশ্চিম কোণায় বিদেশি মেহমানদের জন্য নির্ধারিত কামরার পাশে বয়ান মঞ্চ নির্মাণ করা হচ্ছে।
এছাড়া শামিয়ানা টানানো, বিদ্যুৎ ও মাইক সংযোগের জন্য তার টানানোসহ তাশকিল কামরা, জুড়নেওয়ালি জামাতের কামরা, শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের বয়ান শোনার জন্য পৃথক কামরা তৈরি করা হয়েছে। ১৬০ একর জায়গায় বিশাল সামিয়ানা টানানো হয়েছে। বিশাল ময়দানে খিত্তাভিত্তিক মাইক বাঁধা এবং বৈদ্যুতিক লাইট টানানোর কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ৩ দিনের ইজতেমাকে ঘিরে টঙ্গী ও আশপাশ এলাকায় ধর্মীয় উৎসব আমেজ বিরাজ করছে।
বিশ্ব ইজতেমা আয়োজক কমিটির ডা. খান মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন জানান, প্রথম পর্বের ইজতেমায় মুসল্লিরদের অবস্থানের জন্য ভিবিন্ন ভিন্ন খিত্তা তৈরি করা হয়েছে। এজন্য সামিয়ানা টানিয়ে শতাধিক খিত্তা তৈরি করা হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা মুসল্লিরা তাদের জন্য নির্ধারিত খিত্তায় অবস্থান নিয়ে ইবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকবেন। এছাড়া ময়দানের চারপাশে ১১ ও ১২নং খিত্তার কিছু অংশ, ৩২ ও ৩৭ নম্বর খিত্তার মাঝামাঝি ১২ নম্বর, ৭২, ৭৩, ৮৬ ও ৯১ নম্বর খিত্তাগুলো সংরক্ষিত হিসেবে রাখা হয়েছে।
ইজতেমার প্রথম পর্বের তথ্য সমন্বয়ক জহির ইবনে মুসলিম জানান, ইজতেমা মাঠের শামিয়ানা, আন্তর্জাতিক নিবাস ও আশপাশের সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে স্থানীয় ডেসকোর কয়েকটি টিম কাজ করছে। ২ মাস ধরে বিশ্ব ইজতেমার প্রস্তুতি চলছে। এতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ অনেকে যোগ দিচ্ছেন। হাজারো মুসল্লির স্বেচ্ছাশ্রমে ইজতেমার সার্বিক কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। মুসল্লিদের নিরাপত্তায় পুরো ময়দানে প্রায় ৩০০ ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা বসানো হয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানার ওসি শাহ আলম জানান, ইজতেমা ময়দানে আগত ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের নিরাপত্তায় গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ (জিএমপি) এবং র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ানের (র্যাব) পক্ষ থেকে ৩ শতাধিক ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন করা হচ্ছে। সিসিটিভির মাধ্যমে কন্ট্রোলরুম থেকে ইজতেমা মাঠের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হবে। মাঠের সার্বিক নিরাপত্তায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যরা নিয়োজিত থাকবেন।
সেনাবাহিনীর সদস্যরা তুরাগ নদীর তীরে তৈরি করছেন পন্টুন, যা দিয়ে সাময়িকভাবে মুসল্লিরা এপার থেকে ওপারে যাতায়াত করতে পারবেন। গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ১২টি নলক‚পে ১২ কিলোমিটার পাইপলাইনের মাধ্যমে প্রতিদিন বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা হবে। প্রতি বছরের মতো এবারো উর্দু ভাষায় বয়ান করা হবে এবং বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মুসল্লিদের সুবিধার্থে বয়ানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ও আরবি ভাষায় তরজমা করা হবে।
টঙ্গীর শহীদ আহসানউল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালের পরিচালক জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে ঢাকা থেকে এ হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ টিম কাজ করবে। রোগী পরিবহনের জন্য সার্বক্ষণিক ১৪টি অ্যাম্বুলেন্স মোতায়েন থাকবে। গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোল্লা নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইজতেমার সার্বিক নিরাপত্তায় সাড়ে ৭ হাজার পুলিশ মোতায়েন থাকবে। সিসিটিভি ক্যামেরা, ওয়াচ টাওয়ার ও রুফটপ থেকে পুরো ইজতেমা ময়দানের নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ করা হবে।
এছাড়া স্পেশালাইজড টিমসহ প্রতিটি খিত্তায় সাদা পোশাকে বিপুলসংখ্যক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করবেন। অগ্নিনির্বাপণের জন্য প্রতি খিত্তায় এবার দুটি করে অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা হবে। তুরাগে নৌ টহলও থাকবে। এদিকে জানা গেছে, ইজতেমা মাঠে মুসল্লিদের জন্য প্রায় সাড়ে ৮ হাজার অস্থায়ী টয়লেটের ব্যবস্থা রয়েছে। ময়দানের চাহিদা মোতাবেক ব্লিচিং পাউডার সরবরাহ এবং ২৫টি ফগার মেশিনে মশক নিধনেরও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নিয়মিত পানি ছিটানো, মশার ওষুধ দেয়া, পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা থেকে শুরু করে সব রকমের ব্যবস্থা নেয়া হবে। সেখানে সার্বক্ষণিক একাধিক টিম কাজ করবে। মুসল্লিদের যেকোনো সমস্যায় তারা কাজ করে যাবে।
বৃহস্পতিবার বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মুসল্লির সংখ্যাও বাড়ছে। ধীরে ধীরে ভরে উঠছে ইজতেমার মাঠ। সেইসঙ্গে তীব্র যানজটের কবলে পড়ছে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। বিশেষ করে বিমানবন্দর এলাকায় থেমে থেমে চলছে পরিবহনগুলো। উত্তরা ট্রাফিক পুলিশের উপকমিশনার নাবিদ কামাল শৈবাল বলেন, ইজতেমার কারণেই এ যানজট। অনেকে গাড়িতে করে ইজতেমার মাঠে আসছেন। আবার গাড়ি থেকে নেমে মানুষ পায়ে হেঁটে তুরাগ মাঠে যাচ্ছে। প্রচুর মানুষ রাস্তায় নেমে গিয়ে পারাপার হচ্ছে। ফলে গাড়ির গতিও কমে যায়।
তিনি বলেন, চাপ সামলাতে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় কোনো ত্রুটি নেই। এত মানুষ প্রধান সড়ক দিয়ে পারাপার করছে। এতে উভয় পাশেই গাড়ির জট লেগে যায়। এদিকে যান জটের কারণে বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে বিমানবন্দরগামী যাত্রীদের। ফ্লাইট ধরতে অনেকেই লাগেজ নিয়ে পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন।
এক যাত্রী জানান, ফার্মগেইট থেকে তিনি প্রতিদিন উত্তরা যান অফিস করতে। কিন্তু সকালে মহাখালী ফ্লাইওভার পার হতেই তার ২ ঘণ্টা লেগেছে। পরে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওনা হয়েছেন। এদিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় সকাল থেকে সৃষ্ট যানজটের প্রভাবে ফার্মগেট, শাহাবাগ, মিরপুর কালশী, বনানী এলাকাসহ বেশকিছু জায়গায় দেখা গেছে দীর্ঘ যানজট। সকাল থেকে তীব্র এ যানজটের কারণে ওইসব এলাকা দিয়ে যাতায়াতকারীরা পড়েছেন বিপাকে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় তাদের রাস্তায় পার করতে হচ্ছে। মূলত বুধবার রাত থেকেই যানজটের সৃষ্টি হয়। টঙ্গীর ইজতেমাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মুসল্লিরা এরই মধ্যে ইজতেমা ময়দানে জড়ো হতে শুরু করেছেন। কেউ বাসে করে, কেউবা বিভিন্ন ছোট-বড় যানবাহনে করে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসছেন। কিন্তু তাদের বহনকারী পরিবহনগুলো রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকার কারণে যান চলাচল ব্যাহত হয়। যার প্রভাব পড়ে রাজধানীজুড়ে। যারা উত্তরার দিকে যাচ্ছেন, তাদের বিভিন্ন সড়কে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
২ কিলোমিটার জায়গা অতিক্রম করতে একেকজনের সময় লেগেছে দেড় থেকে ২ ঘণ্টা। সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটের দিকে রাজধানীর গোলাপবাগ মাঠ থেকে বাড্ডা পর্যন্ত আসতে চারবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে জানিয়ে ভুক্তভোগী মোস্তাক রায়হান। তিনি বলেন, রাস্তায় বের হয়েই দেখি তীব্র যানজট। অফিসের সময় হয়ে যাওয়ার কারণে যানজটের মধ্যে চারবার গাড়ি পরিবর্তন করতে হয়েছে। মাঝে বেশ প্রায় ৫ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে আসতে হয়েছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য