-->

দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিকল্পনা

মো. রেজাউর রহিম
দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতার পরিকল্পনা

মো. রেজাউর রহিম: দেশে গত এক দশকে দুধের উৎপাদন বেড়েছে পাঁচগুণের বেশি। তবে দুধ উৎপাদনে এখনো স্বয়ংসম্পূর্ণ নয় বাংলাদেশ। এজন্য নানামুখী পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ খাতে গবেষণা কার্যক্রম সম্প্রসারণ, ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা, উদ্যোক্তা ও খামারিদের প্রণোদনা ও উপকরণ সহায়তা প্রদান, কর অব্যাহতি সুবিধার পাশাপাশি আরো উদ্যোক্তা এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

 

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, স্বল্পসময়ের মধ্যে দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে নানা উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা আধুনিকীকরণ, দুগ্ধজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এজন্য গবাদিপশুর জাত উন্নয়নের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড সম্প্রসারণসহ নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এছাড়া প্রান্তিক খামারিদের দুধের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে সরাসরি বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এজন্য ভিলেজ মিল্ক কালেকশন সেন্টার ও ডেইরি হাব স্থাপন করা হচ্ছে। এছাড়া দেশের মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণ এবং বিদেশে রপ্তানির জন্য বিশেষ পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। আর এ খাতের উদ্যোক্তা ও খামারিদের প্রণোদনা, উপকরণ সহায়তা, কর অব্যাহতিসহ নানা সুবিধার আওতায় আনা হচ্ছে। আর সার্বিক উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খামার যান্ত্রিকীকরণসহ প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে প্রাণিসম্পদ খাতে উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 

সূত্র জানায়, ডেইরি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে ডেইরি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এছাড়া পোলট্রি উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠার বিষয়টিও বিবেচনা করা হচ্ছে। পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ খাতে আরো উদ্যোক্তা সৃষ্টি ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

 

এ বিষয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগ ও ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রাণিসম্পদ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন, দেশের মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদা পূররেণর পাশাপাশি এ খাতে কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টির মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতি সচল রাখা এবং বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।

 

তিনি বলেন, দেশে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের যথাযথ বাজার ব্যবস্থাপনা, দুগ্ধজাত পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ ও সহজলভ্যতা নিশ্চিত করতে নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উৎপাদনকারী খামারিদের ন্যায্যমূল্যে দুধ বিক্রি নিশ্চিত করতে ডেইরি হাব প্রতিষ্ঠা করা হচ্ছে। এছাড়া মহিষ উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে অধিক দুধ উৎপাদনশীল মহিষের কৃত্রিম প্রজনন সম্প্রসারণ কার্যক্রমও চলমান রয়েছে। আশা প্রকাশ করে

 

তিনি বলেন, স্বল্পসময়ে দুধের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের চাহিদা মিটিয়ে দুধ এবং দুগ্ধজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে। মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দুধ, মাংস ও ডিম উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২২.৮৬ লাখ টন, ১০.৮৪ লাখ টন এবং ৪৬৯.৬১ কোটি টন। ২০২১-২২ অর্থবছরে এ উৎপাদন দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ১৩০.৭৪ লাখ টন, ৯২.৬৫ লাখ টন এবং ২৩৩৫.৩৫ কোটিতে। আর গত এক যুগে দেশে দুধ, মাংস ও ডিমের উৎপাদন যথাক্রমে প্রায় পাঁচগুণ, ছয়গুণ ও তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে এ সময়ে দৈনিক জনপ্রতি দুধের চাহিদাও বেড়েছে প্রায় সাড়ে চারগুণ।

 

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশ মাংস ও ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর দুধ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্যে বিশ^ব্যাংকের অর্থায়নে ‘প্রাণিসম্পদ ও ডেইরি উন্নয়ন প্রকল্প’র মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বাড়ানো, মার্কেট লিংকেজ, ভ্যালু চেইন উন্নয়ন, পশুবিমা চালুকরণ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত খাদ্যের ভোক্তা সৃষ্টি’ প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এ কার্যক্রমে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ২৮০ কোটি টাকা।

 

জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ উপখাতের অবদান ১.৯০ শতাংশ এবং জিডিপিতে প্রবৃদ্ধির হার ৩.১০ শতাংশ। মোট কৃষিজ জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ১৫.৫২ শতাংশ ও আর্থিকভাবে যার পরিমাণ প্রায় ৬৭ হাজার ১৮৯ কোটি টাকা। এছাড়া প্রাণিস্বাস্থ্য সুরক্ষা ও প্রাণিসম্পদের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সরকারি উদ্যোগে পশুর টিকা উৎপাদন বৃদ্ধি করা হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রায় ৩২.০৫ কোটি টিকা উৎপাদন করেছে এবং ৩১.৯২ কোটি ডোজ টিকা প্রয়োগ করেছে। এছাড়া পশু চিকিৎসার জন্য ৬১ জেলার ৩৬০টি উপজেলায় ভ্রাম্যমাণ প্রাণিচিকিৎসা ক্লিনিক চালু করা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ৬১টি উপজেলায় আধুনিক ও জরুরি প্রাণী চিকিৎসাসেবার লক্ষ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক বিতরণ কার্যক্রমের কাজ শুরু হয়েছে।

 

এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বলেন, দুধ উৎপাদনকারী খামারিদের উৎপাদিত দুধ বিক্রি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে দেশে দুধের উৎপাদন আরো বাড়বে। এজন্য আমরা সারা দেশে ৫ হাজার ৫০০ গ্রুপ তৈরি করেছি, যার মাধ্যমে আমাদের এ প্রক্রিয়া শুরু হবে। সরকার দুধ উৎপাদনে সয়ংসম্পূর্ণতার লক্ষ্য অর্জনে কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, গত এক দশকে কৃত্রিম প্রজনন প্রযুক্তির সম্প্রসারণ, জাত উন্নয়ন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির কারণে দেশে দুধের উৎপাদন চারগুণ বেড়েছে। এছাড়া দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন মাননিয়ন্ত্রণ গবেষণাগার স্থাপন করা হয়েছে।

 

তিনি আরো বলেন, দুধের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের পাশাপাশি এ খাত থেকে রপ্তানির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আমরা কাজ করছি। উল্লেখ্য, এশিয়া মহাদেশের বিভিন্ন দেশে বিশে^র মোট উৎপাদিত দুধের ৪০ শতাংশ উৎপাদন হয়। বিশে^র শীর্ষ দুধ উৎপাদনকারী দেশ ভারত। এরপর পর্যায়ক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, চীন, পাকিস্তান, ব্রাজিল ও রাশিয়ার অবস্থান।

মন্তব্য

Beta version