-->
শহরের নিন্ম আয়ের অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ পানি থেকে বঞ্চিত

কমছে নিরাপদ মিঠাপানির উৎস

শাহীন রহমান
কমছে নিরাপদ মিঠাপানির উৎস

শাহীন রহমান: পানির অপর নাম জীবন। প্রতি বর্গকিলোমিটারে মিঠা পানির প্রাপ্যতার হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান পৃথিবীর মধ্যে প্রথম। মাটির ওপরের স্তরের পানি এবং বৃষ্টির পানি মিলিয়ে হিসাব করলেও বাংলাদেশ পৃথিবীতে পানি প্রাপ্যতার শীর্ষস্থানীয় দেশ। কিন্তু মিঠাপানির এদেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে মানুষ যে পানি ব্যবহার করছে, তা কতটুকু নিরাপদ?

 

বিশ্বব্যাংকের ২০১৮ সালের রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে,বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ অপরিছন্ন ও অনিরাপদ উৎসের পানি পান করে। পানির নিরাপদ উৎসগুলোর ৪১ শতাংশই ক্ষতিকর ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়া যুক্ত।

 

ঢাকাসহ অন্য শহরগুলোতে পাইপের মাধ্যমে বাসাবাড়িতে সরবরাহ করা পানিতে এই ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি সবচেয়ে বেশি প্রায় ৮২ শতাংশ। এর সঙ্গে ১৩ শতাংশ রয়েছে আর্সেনিক সমস্যা।

 

ডক্টরস প্ল্যাটফর্ম ফর পিপলহেলথের তথ্যমতে দেশের ৪১ শতাংশের অধিক মানুষ দূষিত পানি পান করছে। চিকিৎসা করাতে গিয়ে প্রতি বছর ৬৪ লাখ মানুষ দরিদ্র হচ্ছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাইপলাইনের মাধ্যমে সরবরাহ করা পানিতে ব্যাকটেরিয়া কেন এবং কীভাবে ঢুকেছে তা দেখার দায়িত্ব পানি সরবরাহকারী কর্তৃপক্ষের। কিন্তু তারা তাদের সঠিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। এর ভুক্তভোগী হচ্ছে নগরের নিন্ম আয়ের সাধারণ মানুষ। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা পানি নিরাপদ করতে পানি ফুটিয়ে পান করার কথা বলছেন

 

কিন্তু ভুক্তভোগীরা বলছেন, ওয়াসার পানি ফুটিয়ে গন্ধ দূর করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, দেশে পানির উৎস কি কমে আসছে?

 

পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্তি মহাপরিচালক প্রকৌশলী আব্দুস সোবহান বলেন, পাইপলাইনে সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে অভিযোগ দীর্ঘদিনের। কিন্তু এসব অভিযোগের কোনো সুরাহা হয়নি আজও। প্রতিনিয়ত অনিরাপদ পানি পানের কারণে শহরের মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। এ থেকে রক্ষা পাওয়া না গেলে, সবার জন্য নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা না গেলে দেশে জনস্বাস্থ্য মারত্মক হুমকির মুখে পড়বে।

 

তিনি জানান, প্রতিবছর গরমের সময় দেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে, তার প্রধান কারণ হলো অনিরাপদ পানি। এ কারণে প্রতি বছর অনেক মানুষের মৃত্যু হচ্ছে।

 

ঢাকা ওযাসার তথ্যমতে, প্রতিদিন ঢাকার মানুষের ২৬০ থেকে ২৬৫ লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে তারা ২৭০ কোটি থেকে ২৭৫ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করে। তবে অভিযোগ রয়েছে, ওয়াসার পানির জন্য অনেককে মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়।

 

আবার অবৈধ সংযোগ কম নয়। অবৈধ সংযোগের কারণে মাঝেমধ্যেই স্যুয়ারেজের বর্জ্য থেকে শুরু করে নানারকম দূষণ ও রোগ-জীবাণু পানির লাইনে ঢুকে পড়ে। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করে। এ ছাড়া নগরের রাস্তাঘাট এবং খাবারের দোকানে-ফুটপাতে যেসব পানি ব্যবহার করা হচ্ছে তার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

 

সাধারণত নিন্ম আয়ের মানুষ যারা বেশিরভাগ সময় রাস্তাঘাটে কাটায়, তারা সাধারণত খোলাবাজারের খাবার গ্রহণ করে। যেখান থেকে নানা ধরনের রোগ-জীবাণু মানুষের শরীরে প্রবেশ করে ডায়ারিয়াসহ নানা ধরনের রোগের সৃষ্টি করে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন আইন ২০১১-তে নগরের বস্তিবাসীদের বিষয়ে বলা হয়েছে, ওয়াসা কর্তৃপক্ষ জনস্বাস্থ্য ও দারিদ্র্য বিবেচনায় বস্তিতে পানির সংযোগ দিতে পারবেন। বস্তির পানি সংযোগ ফি, অন্যান্য ব্যয় এবং কর কোনো ক্রমেই আবাসিক হারের চেয়ে বেশি হবে না। কিন্তু ঢাকার লাখ লাখ বস্তিবাসীর বাস্তবতা খুবই বৈষম্যপূর্ণ। তারা পানির জন্য অধিক টাকা খরচ করেও বিশুদ্ধ এবং সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ডায়ারিয়া-কলেরাসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের আয়ের একটি রিবাট অংশ টাকা খরচ করে ব্যয় হচ্ছে চিকিৎসার পেছনে।

 

বিশেষজ্ঞরা আরো বলছেন, নিরাপদ পানি পানের অভাবে প্রতি বছরই দেশে ডায়ারিয়া-কলেরা রোগে প্রচুর মানুষ মারা যায়।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাস (জানুয়ারি-মার্চ) সারা দেশে ৪ লাখ ৬১ হাজার ৬১১ জন মানুষ ডায়ারিয়া রোগে আক্রান্ত হয়েছে। আইসিডিডিআর,বির তথ্যমতে, তাদের হাসপাতালে আসা রোগীদের ২৩ শতাংশ তীব্র ডায়ারিয়া বা কলেরা রোগে আক্রান্ত। গরমকালে বর্ষা শুরু হওয়ার আগে এবং বর্ষা শুরু হওয়ার শেষে প্রতি বছরই ডায়রিয়া রোগ হয়ে থাকে।

 

তাদের মতে, এ সময় গরম বেড়ে যাওয়ার কারণে ডায়ারিয়ার ব্যাকটেরিয়াগুলো দ্রুত বংশ বিস্তার করে। তাছাড়া নিরাপদ পানি সংকটও গুরুতপূর্ণ কারণ।

 

তারা বলেন, ডায়ারিয়া পানিবাহিত রোগ। একদিকে নিরাপদ পানির অভাব আর অন্যদিকে বিপুল সংখ্যক মানুষ মলমূত্র ত্যাগে অনিরাপদ বা স্বাস্থ্যসম্মত ব্যবস্থাপনার বাইরে থেকে যাওয়ায় দ্রুত ডায়ারিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এসব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আর্থসামাজিক কাঠামো উন্নয়নে গুরুত্ব না দেয়ায় প্রতি বছরই দেশে ডায়ারিয়া রোগের প্রকোপ বেড়েই যাচ্ছে।

 

এ অবস্থায় বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলে বলছেন, বাংলাদেশ পৃথিবীতে পানিপ্রাপ্যতার শীর্ষস্থানীয় দেশ। তাহলে আমরা এখনো দেশের মানুষের সুপেয় পানির সংকট দূর করতে পারছি না কেন, সেটা আমাদের বোধগম্য নয়। তারা বলছেন, সচ্ছল আর বিত্তবান মানুষ এ রোগে ভুগছেন না। জনস্বাস্থ্যের এমন সংকটের শিকার হচ্ছে দেশের গরিব ও নগরের নিন্ম আয়ের মানুষ। এই সংকট থেকে উত্তরণে জরুরি পদক্ষেপ নেয়ার আহব্বান জানান তারা।

 

মন্তব্য

Beta version