-->

সমাবেশ নয়, যেন মিলনমেলা

নিখিল মানখিন
সমাবেশ নয়, যেন মিলনমেলা

নিখিল মানখিন : জনসমুদ্রে পরিণত যুবলীগের মহাসমাবেশ। সমাবেশস্থল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরের চেয়ে বাইরে ছিল দশগুণ বেশি মানুষের সমাগম। সারাদেশ থেকে আগত নেতাকর্মীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা পার্ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ চারপাশের কয়েক কিলোমিটার এলাকা।

 

আয়তন বিবেচনায় প্রায় আটশ একরের বেশি এলাকার রাস্তাঘাট, অলিগলি ও খোলা জায়গায় ছিল যুবাদের উপচেপড়া ভিড়। সমাবেশ রূপ নেয় মিলনমেলায়। ক্রেতা সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে সমাবেশস্থলের বাইরে চারপাশে সাজানো ভাসমান দোকানগুলো। নিরাপত্তা প্রদানে র‌্যাব, পুলিশ এবং সমাবেশস্থলের প্রবেশপথে সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি দেখা গেছে। সমাবেশ এলাকা সরেজমিন ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।

 

সমাবেশস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বর্ণাঢ্য সাজে সেজেছে। লেকের পূর্বপ্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল মঞ্চ। ব্যানার-ফেস্টুনের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানো হয়েছে পুরো সোহরাওয়ার্দী উদ্যান।

 

শুক্রবার দুপুর আড়াইটার পর আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছালে সমাবেশের কার্যক্রম শুরু হয়। আওয়ামী লীগ সভাপতিকে সভামঞ্চে ফুল দিয়ে বরণ করেন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল। প্রধানমন্ত্রীর হাতে তারা ক্রেস্ট তুলে দেন। সভামঞ্চের সামনে প্রধানমন্ত্রী জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

 

যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ উত্তোলন করেন দলীয় পতাকা। এরপর বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে, জাতীয় সংগীত গেয়ে ঐতিহ্যবাহী এ সংগঠনের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী সমাবেশস্থলে উপস্থিত হলে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান। ‘শেখ হাসিনা সরকার, বারবার দরকার’, ‘ধন্য পিতার ধন্য কন্যা, জননেত্রী শেখ হাসিনা’, ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘আজকের এই দিনে পিতা তোমায় মনে পড়ে, আজকের এই দিনে, মনি তোমায় পড়ে মনে’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকেন নেতাকর্মীরা।

 

যুবলীগের ৫০ বছর পূর্তি ও সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যুব মহাসমাবেশ যেন সাময়িক সময়ের জন্য পাল্টে দেয় রাজধানীর রূপ। সায়েন্স ল্যাবরেটরি মোড়, বাংলামটর মোড়, গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট, নীলক্ষেত মোড় ও নগরভবন এই পয়েন্টগুলো থেকে স্বাভাবিক যান চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়।

 

এই পয়েন্টগুলোর ভেতরের পুরো রাস্তাঘাট, অলিগলি ও খালি জায়গাজুড়ে ছিল মানুষের ঢল। শুক্রবার সকাল থেকেই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসতে শুরু করেন যুবলীগের নেতাকর্মীরা। বিভাগভিত্তিক আলাদা রংয়ের টি-শার্ট আর ক্যাপ পরে আসেন তারা। ব্যানার, ফেস্টুন, প্ল্যাকার্ড, বাদ্যযন্ত্র নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রবেশ করেন তারা। ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখার আগামীদিনের পদপ্রত্যাশীদের ছবি, দেশের বিভিন্ন জেলা-মহানগরের পদপ্রত্যাশীদের ছবি নিয়েও আলাদা আলাদা মিছিল আসে।

 

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নির্মাণ করা হয় সুবিশাল প্যান্ডেল। রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের পাশে জাতীয় পতাকার পাশাপাশি যুবলীগের পতাকাজুড়ে দেয়া হয়। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে ভোরেই গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট, মৎস্যভবন, শাহবাগ, কাকরাইল, সেগুনবাগিচা, এলিফ্যান্ট রোড, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, দোয়েল চত্বরসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের চারদিকেই নেতাকর্মীরা এসে জড়ো হয়ে মিছিল নিয়ে উদ্যানে প্রবেশ করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনার গেটটি ভিআইপি গেট ছাড়া টিএসসি রাজুভাস্কর্য গেট, মেট্রো রেলের স্টেশন গেট, রমনা কালীমন্দির গেটে প্রবেশমুখে নেতাকর্মীদের তল্লাশি করে ঢোকার অনুমতি দেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা।

 

কেউ কেউ রিজার্ভ বাস, পিকআপ, মোটরসাইকেলের বহর নিয়ে যোগ দেন আবার অনেককে পায়ে হেঁটে সমাবেশে যোগ দিতে দেখা গেছে। সামুয়েল চিরান ও পিবলু মানখিন এসেছেন ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থেকে। সামুয়েল চিরান ভোরের আকাশকে জানান, রাত ১২টার পর রিজার্ভ বাসে ধোবাউড়া থেকে রওনা দিয়েছি। থানা থেকে তিনশজনের মতো নেতাকর্মী এসেছে। শাহবাগ এলাকায় ভিড় থাকায় ধানমন্ডির ভ‚তের গলির একটি রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়েছেন বলে জানান সামুয়েল চিরান।

 

ভালুকা থেকে ইউনিয়ন যুবলীগ নেতা মো. সাইদুল বন্ধু মো. শফিককে নিয়ে সমাবেশে এসেছেন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, দলের রিজার্ভ পরিবহনে আসতে পারিনি। বন্ধুকে নিয়ে শুক্রবার সকালে রওনা দিয়ে দশটায় পৌঁছেছি। সমাবেশে যোগদান করতে পেরে খুব খুশি লাগছে বলে জানান মো. সাইফুল।

 

ঢাকাঢোল, ব্যান্ডপার্টি, সাউন্ডবক্সসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে সমাবেশে আসেন অনেক এলাকার নেতাকর্মী। তবে লক্ষীপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান ও সাবেক যুবলীগ সভাপতি একেএম সালাউদ্দীন টিপু দেখালেন ভিন্ন চমক। দেশের ঐতিহ্যবাহী লাঠিখেলা প্রদর্শন করতে করতে তারা মহাসমাবেশে গেছেন। মিছিলের সামনে এই লাঠিখেলার নৃত্য নজর কেড়েছে অনেকের।

 

শুক্রবার দুপুর ১২টার দিকে দেখা যায়, হাইকোর্টের সামনে দিয়ে দোয়েল চত্বর হয়ে মিছিলটি এগোচ্ছে। মিছিলের সামনে আটজন হাতে দুটি করে লাঠি নিয়ে লাঠি খেলা প্রদর্শনের পাশাপাশি ঢাক ও কেসিওর তালে নাচতে নাচতে যাচ্ছেন।

 

এই লাঠিয়াল দলের সরদার মো. মোস্তফা বলেন, সদরঘাট থেকে আমরা লাঠিখেলা দেখাতে দেখাতে আসছি। পরিশ্রম হয়ে গেছে। তবে সবাই আমাদের দেখছে, তাই ভালো লাগছে। আর এই খেলা আমাদের দেশের ঐতিহ্য। এই মিছিলের নেতৃত্বে থাকা লক্ষিপুর সদর উপজেলার চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দীন টিপু বলেন, পাঁচ হাজারের মতো নেতাকর্মী নিয়ে এসেছি। কেউ বাসে এসেছে, কেউ লঞ্চে। নেত্রীকে ভালোবেসে তারা এসেছে। লাঠিখেলার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, লাঠিখেলা দেশের ঐতিহ্যবাহী খেলা। তাই আমরা দেশের ঐতিহ্যকে সামনে রেখে মিছিল নিয়ে যাচ্ছি বলে জানান একেএম সালাউদ্দীন।

 

ক্রেতা সামাল দিতে হিমশিম খেয়েছে সমাবেশস্থলের বাইরে চারপাশে সাজানো ভাসমান দোকানগুলো। শাহবাগের জাতীয় জাদুঘরের সামনে সাজানো চা দোকানগুলোতে ছিল উপচেপড়া ভিড়। দুপুর ১২টার দিকে নাসির চা স্টোরের মালিক মো. নাসিরউদ্দিন ভোরের আকাশকে জানান, বিক্রি বেড়েছে অনেক গুণ। চা বানাতে বানাতে কাহিল হয়ে যাচ্ছি। সকাল থেকে ৫০০ কাপের বেশি চা বিক্রি করেছেন বলে জানান মো. নাসিরউদ্দিন। একই কথা জানালেন পাশের দোকানদার মো. সিরাজ। তিনি বলেন, রং চায়ের চাহিদা বেশি। দুঘণ্টার ব্যবধানে ব্যস্ততা বেশি বেড়েছে। বাড়তি দুই ছেলে ডেকে এনেছি। কষ্ট হলেও চা বেশি বিক্রি হওয়ায় ভালো লাগছে বলে জানান মো. সিরাজ।

 

সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের তেমন বিচরণ ছিল না। কিন্তু স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেকগুণ বেশি খাবার ও চা বিক্রি করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরের খাবার দোকানদার মো. সুমন। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও ঢাবি ক্যাম্পাসে সমাবেশ হলেই আমরা বাড়তি খাবার প্রস্তুত করে রাখি। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। ডিম খিচুড়ি মাত্র ২৫ টাকায় এবং রং চা ৫ টাকায় বিক্রি করেছেন বলে জানান মো. সুমন।

২৫ টাকায় ডিম খিচুড়ি পেয়ে খুব খুশি নরসিংদী থেকে আগত যুবলীগ কর্মী মো. কাশেম মিয়া। তিনি ভোরের আকাশকে জানান, নরসিংদী থেকে অনেক মানুষ এসেছে। তাদের অনেকে আশপাশের এলাকাগুলোতে খাবার হোটেল খুঁজতে গেছেন। আমার এক আত্মীয়ের ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ে। তার মাধ্যমেই আমরা এখানে অল্প খরচে ভালো খাবার খেতে পেরেছি বলে জানান মো. কাশেম।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসি এলাকায় কথা হয় নুরু নামে এক ঝালমুড়ি বিক্রেতার সঙ্গে। তিনি বলেন, ভালো বেচাবিক্রি হচ্ছে। নিয়মিত এই এলাকায় ঘুরে ঘুরে বিক্রি করলেও আজ খুব একটা ঘুরতে হচ্ছে না। লোকজন এগিয়ে আসছেন ঝালমুড়ি খেতে।

 

তার কিছু দূরেই কথা হয় শরবত বিক্রেতা দুলালের সঙ্গে। তিনি বলেন, গরম আছে কিছুটা। হেঁটে এসে ক্লান্ত মানুষজন এক গøাস শরবত খেয়ে গলা ভেজাচ্ছে। অন্যদিনের তুলনায় বিক্রি বেশি বলেও জানান তিনি।দোয়েল চত্বর এলাকায় ভ্যানে আনারস বিক্রি করছেন হানিফ। তার দোকানে রসালো আনারস খেতে একপ্রকার ভিড় দেখা গেছে। বিক্রেতা হানিফ বলেন, আনারস রসালো হওয়ায় মানুষ খাচ্ছে। অন্যদিন বিক্রি করতাম আজিমপুর কবরস্থানের কাছে, সমাবেশকে কেন্দ্র করেই ভালো বিক্রির আশায় আজ এখানে এসেছেন বলে জানান মো. হানিফ।বোতলের পানি বিক্রি করছেন কবীর খান। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ১৫ টাকার বোতল বিক্রি করছি ২০ টাকায়। টাকা নিয়ে ভাবছে না মানুষ।

 

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version