-->

সমৃদ্ধির প্রার্থনা মহালয়ায়

শিপংকর শীল
সমৃদ্ধির প্রার্থনা মহালয়ায়

ঢাকা: মহামারি করোনাভাইরাসের পর যে আলোর রেখা ফুটেছিলো বিশ্ব চরাচরে, তা যেন নিমিষে উবে গেলো ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ৷ বৃথা রক্তপাত তো হলো, সঙ্গে বিশ্বজুড়ে শুরু হলো অর্থনীতির মহাসংকট। শরণার্থী সংকট ঘনীভূত হয়েছে, বেড়েছে দারিদ্র্যতা।

 

এমন সময়েই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব, শারদীয় দুর্গোৎসব শুরু হচ্ছে আগামী ১ অক্টোবর থেকে।

 

ধরণীজুড়ে এমন শঙ্কা, সংকটের মধ্যে বছর ঘুরে মর্ত্যে শুরু হচ্ছে শারদীয় দুর্গোৎসব। হিন্দু আচার অনুযায়ী, মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা- এই তিন পর্ব মিলে দুর্গোৎসব। সাধারণত আশ্বিন মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠ থেকে দশম দিন হয় দুর্গাপূজার মূল আনুষ্ঠানিকতা। আশ্বিন মাসের এই শুক্ল পক্ষকে বলা হয় দেবীপক্ষ।

 

দেবীপক্ষের শুরু হয় যে অমাবস্যায়, সেদিন হয় মহালয়া; সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, মহালয়ার প্রাক সন্ধ্যায় কাত্যায়নী মুনির কন্যারূপে মহিষাসুর বধের জন্য দেবী দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।

 

রাজধানীর ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরসহ সারাদেশের মন্দিরে-মণ্ডপে রোববার ভোর থেকে শুরু হয়েছে মহালয়ার আচার। ঘট স্থাপন ও পূজার মধ্য দিয়ে চলেছে ‘মহাশক্তি, মহামায়া, দুর্গতিনাশিনী' দেবী দুর্গাকে মর্ত্যে নেমে আসার আবাহন।

 

ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরের পুরোহিত বরুণ চক্রবর্তী বলেন, মহালয়ায় প্রথমে চণ্ডীপাঠ করে দেবীকে আহ্বান জানানো হয়। এ সময় মঙ্গলঘট স্থাপন করে তাতে ফুল, তুলসী ও বেলপাতা দিয়ে করা হয় পূজা। এছাড়া সারাদিনই বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা থাকে মহালয়ায়।

 

ঢাকেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার মূল আচার শুরু করেন সকাল ১০টায়।

 

দেবীপক্ষের আগের পক্ষ হল পিতৃপক্ষ। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোক বা যমলোকে বাস করেন। আর এই পিতৃলোকের অবস্থান স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যু দেবতা যম। তিনি সদ্য মৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। এরপর পরের প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে আগের প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন। একই সঙ্গে পরমাত্মায় বা ঈশ্বরে বিলীন হন। এ কারণে মহালয়ায় হিন্দুরা তাদের পূর্বে মারা যাওয়া তিন প্রজন্মের ব্যক্তিদের স্মরণ বা তর্পণ করে থাকেন। এ দিন শ্রদ্ধানুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি দেন তারা।

 

এর আগে বুধবার ভোরে ঢাকেশ্বরী জাতীয় মন্দিরে মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্জ্বলন করে মহালয়ার আনুষ্ঠানিকতার উদ্বোধন করেন ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার বিনয় জর্জ, তার সঙ্গে ছিলেন বাংলাদেশে ভারত হাইকমিশনের ফার্স্ট সেক্রেটারি অনিমেষ চৌধুরী (রাজনৈতিক ও তথ্য)।

 

বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসও এসেছিলেন ঢাকেশ্বরী মন্দিরে।

 

তিনি বলেন, বহু ধর্মের মানুষের বসবাস এই বাংলাদেশে৷ এখানে ধর্মীয় উৎসব অনেক, তাতে সব ধর্মের মানুষের অংশগ্রহণ দারুণ ব্যাপার। সব ধর্মের উৎসব আনন্দের হোক।হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্তলোকে উৎসব।

 

সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব। রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত। আর মর্তলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন।

 

শাস্ত্র বলছে, মহাসপ্তমীর দিন রোববার হওয়ায় তিনি আসবেন হাতিতে। শাস্ত্রমতে গজ দেবীর উৎকৃষ্টতম বাহন। তাই দেবীর আগমন বা গমন হাতিতে হলে মর্ত্যলোক ভরে ওঠে সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধিতে; পূর্ণ হয় ভক্তদের মনোবাঞ্ছা। পরিশ্রমের সুফল পায় মর্তলোকের অধিবাসীগণ। অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টি নয়, ঠিক যতটা প্রয়োজন ততটা বর্ষণ।

 

আগামী ৫ অক্টোবর বুধবার পড়েছে বিজয়া দশমী। মা দুর্গা পুত্র-কন্যা সহ কৈলাশে ফিরবেন নৌকায় চেপে। শাস্ত্রমতে, সপ্তমী বা দশমী বুধবার হলে দেবীর আসা বা যাওয়া নৌকায়। ফল ‘শস্য বুদ্ধিস্তথাজলম’ অর্থাৎ প্রবল বন্যা ও খরা দেখা যায়। নৌকায় মনোকামনা পূর্ণ হওয়া সূচিত হয়। ধরিত্রী হয়ে ওঠে শস্য শ্যামলা। কিন্তু সেই সঙ্গে অতি বর্ষণ বা প্লাবনের আশঙ্কাও দেখা যায়।

 

দুর্গোৎসবের আনুষ্ঠানিকতায় মুখর হয়ে উঠেছে মন্দির-মণ্ডপ; শেষ মুহূর্তে দেবী দুর্গা, স্বরস্বতী-লক্ষ্মী-গণেশ প্রতিমা রাঙিয়ে তোলায় ভীষণ ব্যস্ত সময় যাচ্ছে প্রতিমা শিল্পীদের।এ বছর সারা বাংলাদেশে ৩২ হাজার ১৬৮ টি পূজামণ্ডপে উদযাপন করা হবে শারদীয় দুর্গোৎসব; যা গত বছরের চেয়ে এবার পূজার সংখ্যা বেড়েছে ৫০টি। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৪১ টি, যা গত বছরের থেকে ৬টি বেশি।

 

গত বছর শারদীয় দুর্গোৎসবে কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ দেশের নানা জেলায় মন্দিরে-মণ্ডপে হামলা, ভাংচুরসহ নানা সহিংসতার ঘটনায় সরকার এবার নিরাপত্তা ইস্যুটিকে সর্বোচ্চ প্রাধাণ্য দিচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কঠোর নজরদারি জারি করা হয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ গুজব রটালে কঠোর ব্যবস্থা নেবে সরকার।

 

বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক চন্দ্রনাথ পোদ্দার লিখিত বক্তব্যে জানান, গত বছর সারাদেশে দুর্গাপূজার সংখ্যা ছিল ৩২১১৮ টি। এবার এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩২১৬৮ টি। যা গত বছরের চাইতে ৫০ টি বেশি। ঢাকা মহানগরে পূজার সংখ্যা ২৪১ টি, যা গত বছরের থেকে ৬টি বেশি।

 

তিনি বলেন, আমরা সম্পূর্ণভাবে নিরাপদ একথা বলা যাবে না। ঘটনা ঘটতে পারে, তবে আমরা এবার খুব সচেতন। সর্বোচ্চ সিসিটিভির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। গ্রামে বিভিন্ন বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে সেই মন্দিরগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ যেগুলো অস্থায়ী মন্দির। স্থায়ী জায়গায় না হয়ে মাঠে, ময়দানে বা বিভিন্ন রাস্তাঘাটে যেসব মন্ডপ স্থাপন করা হয়, সেগুলো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। সেখানে আমাদের বেশি বেশি পাহারা দিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version