-->
শিল্পকলায় ভোজনরসিকদের মেলা

পিঠা-পায়েস খাওয়া উৎসবেই সীমাবদ্ধ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
পিঠা-পায়েস খাওয়া উৎসবেই সীমাবদ্ধ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: পৌষ পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে/আরো উল্লাস বাড়িয়াছে মনে মায়ের বকুনি পেয়ে। কবি সুফিয়া কামাল পিঠা খাওয়ার কথা মনে করে লিখেছেন এমন কথা। কবি জসীম উদ্্দীন তার নকশীকাঁথার মাঠ কাহিনি কাব্যে মেহমানকে যত্ন করার খাতিরে উল্লেখ করেছেন, ও সাজু তুই বড় মোরগ ধরগে যেয়ে বাড়ি/ আমি এদিক ওপাড়ার তে দুধ আনি এক হাঁড়ি।

 

এভাবেই একসময় পিঠা-পায়েস দিয়ে স্বজনদের আপ্যায়ন করা হতো। এখন মেহমান আপ্যায়নে সেই রীতি অনেক কমে গেছে। মেহমান বিদায় হয় আধুনিক সব খাবার দিয়ে। ফাস্টফুড দিয়ে। এখন পিঠা-পায়েস খাওয়ার রীতি সীমাবদ্ধ হয়েছে মেলা বা উৎসবের মধ্যে। সে লক্ষ্যে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রান্তরে চলছে ষোড়শ পিঠা উৎসব।

 

খাদ্যরসিক বাঙালি প্রাচীনকাল থেকে প্রধান খাদ্যের পরিপূরক মুখরোচক অনেক খাবার তৈরি করে আসছে। তবে পিঠা সর্বাধিক গুরুত্বের দাবিদার। শুধু খাবার হিসেবেই নয়, বরং লোকজ ঐতিহ্য এবং নারী সমাজের শিল্প নৈপুণ্যের স্মারকরূপেও পিঠা বিবেচিত হয়। বাঙালির হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে পিঠা। যখনই পিঠা-পায়েস, পুলি কিংবা নাড়ুর কথা ওঠে, তখনই যেন শীত ঋতুটি আমাদের চোখে ও মনে ভেসে ওঠে। প্রতি শীতেই গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে শুরু হয় পিঠা-পুলির উৎসব। দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে ভাটা পড়েছে এই রীতি। এখন কালেভদ্রে মেলা হলে খাদ্যরসিকরা ছুটে আসেন সেখানে। এখন রাজধানীর শিল্পকলায় দেখা মিলছে সেই পরিবেশ।

 

১৯ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রান্তরে শুরু হয়েছে এ উৎসব। আজ মেলা শেষ। তবে সময় আরো দুদিন বাড়তে পারে বলে জানিয়েছেন একটি সূত্র। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং শিল্পকলা একাডেমির সহযোগিতায় উৎসবের আয়োজন করেছে জাতীয় পিঠা উৎসব উদযাপন পরিষদ। বিকেলে শিল্পকলা একাডেমির কফি হাউসের সামনে উন্মুক্ত মঞ্চে উৎসবের উদ্বোধন হয় বেলুন ও পায়রা উড়িয়ে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ।

 

মেলায় বেড়াতে আসা প্রবীণ আক্কাস শেখ ভোরের আকাশকে বলেন, ‘একসময় শীত এলে, নবান্ন এলে ঘরে ঘরে পিঠা তৈরির ধুম পড়ে যেত। আমাদের মা-চাচি, দাদি-নানিরা কত রকম পিঠা বানাতেন। পেটপুরে সেসব পিঠা খেতাম। মেহমান এলে পিঠা দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। আমাদের মা-চাচিদের কোনো ক্লান্তি ছিল না। তারা পরিবারের লোকদের আবদার মেটাতে পারলেই খুশি হতেন। এখন তো সেসব নেই। মেহমান এলে এখন ফাস্টফুড দিয়ে দায়সারা হয়। মেলায় এসেই মেটাতে হয় শখ।

 

একই বিষয়ে রাজীব হোসেন নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘মেলায় এসে খুব ভালো লাগছে। এখানে নানা ধরনের পিঠা দেখা যাচ্ছে। তবে ঘুরেফিরে সব দোকানে একই ধরনের পিঠা। এছাড়া পিঠার দামও অনেক বেশি। একটা পিঠা খেতে খরচা করতে হচ্ছে ৪০ থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত। যারা এর আয়োজন করেন তাদের একটি দাম ঠিক করে দেয়া উচিত।

 

এবারের উৎসবে প্রায় ৬০টি স্টলে নানা পদের পিঠা নিয়ে হাজির হয়েছেন দেশের নানা প্রান্তের পিঠাশিল্পীরা। এসব স্টলে ঠাঁই পেয়েছে বিচিত্র স্বাদ ও নকশার রকমারি পিঠা। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা, আন্দশা, কুলশি, কাটা পিঠা, ঝাল পিঠা, মালপোয়া, মেড়া পিঠা, মালাই পিঠা, কলা পিঠা, খেজুরের পিঠা, ক্ষীর কুলি, গোকুল পিঠা, গোলাপ ফুল পিঠা, লবঙ্গ লতিকা, রসফুল পিঠা, সুন্দরী পাকান, সরভাজা, পুলি পিঠা, পাতা পিঠা, পাটিসাপটা, পাকান পিঠা, নারকেলের সেদ্ধ পুলি, নারকেল জিলাপি, তেলের পিঠা, ফুলঝুরি পিঠাসহ নানান নকশি ও বাহারি নামের পিঠা।

 

শীতের সময় বাহারি পিঠার উপস্থাপন ও আধিক্য দেখা যায়। বাঙালির লোক ইতিহাস ও ঐতিহ্যে পিঠাপুলি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে আসছে বহুকাল ধরে। এটি লোকজ ও নান্দনিক সংস্কৃতিরই বহিঃপ্রকাশ। যান্ত্রিক সভ্যতার এই ইট-কাঠের নগরীতে হারিয়ে যেতে বসেছে পিঠার ঐতিহ্য। সময়ের স্রোত গড়িয়ে লোকজ এ শিল্প আবহমান বাংলার অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে উঠলেও এ যুগে সামাজিকতার ক্ষেত্রে পিঠার প্রচলন অনেকটাই কমে এসেছে।

 

এদিকে মেলায় যারা স্টল দিয়েছেন, তারা বেচাবিক্রিতে খুশি। এ বিষয়ে দোলন পিঠাঘরের মালিক দোলন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘প্রতি বছরই আমরা মেলায় স্টল দিই। তবে এবার বিক্রি ভালো। আমরা চাচ্ছি সময় আরো কিছুদিন বাড়ানো হোক।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version