-->

সওজের সেই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু

এম বদি-উজ-জামান
সওজের সেই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু

এম বদি-উজ-জামান : অবশেষে চট্টগ্রামে দায়িত্বরত সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের সেই দুই তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জামাল উদ্দিন ও এএসএম শাহরিয়ার চৌধুরীর বিরুদ্ধে তদন্তে মাঠে নেমেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়। সওজের ওই দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন এবং একটি রাজনৈতিক দলের এক নেতার কাছে টাকা পাচারের সঙ্গে যুক্ত। এ অভিযোগ তদন্তে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। এর একটি কমিটির প্রধান করা হয়েছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (সম্পত্তি অধিশাখা) সৈয়দা ফারহানা কাউনাইনকে। এ বিষয়ে ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে কথা বলতে যুগ্ম সচিব সৈয়দা ফারহানা কাউনাইনকে মোবাইলে ফোন করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি, মেসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।

 

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির নির্দেশে এ তদন্ত শুরু হয়েছে বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ১৫ ও ১৭তম সভায় ওই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিশদ আলোচনা শেষে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। ওই দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে গত ৩ অক্টোবর ভোরের আকাশ পত্রিকায় ‘সওজের দুই প্রকৌশলীর এত সম্পদ!’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন এবং মো. আলী আজগরের দাখিল করা অভিযোগ আমলে নিয়ে এ তদন্তের সিদ্ধান্ত হয় বলে জানা গেছে।

 

সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিবের প্রতি তদন্তের নির্দেশনা দিয়েছে সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। অভিযোগ তদন্ত শেষে সংসদীয় কমিটির কাছে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। বিষয়টি অতীব জরুরি উল্লেখ করে গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর এবং গত ১ জানুয়ারি পৃথকভাবে এ নির্দেশনা দেয় সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। প্রকৌশলী এএসএম শাহরিয়রের বিষয়ে তদন্তের জন্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের কমিটি শাখা-১৫ এর সহকারী সচিব মো. খালেকুজ্জামানের স্বাক্ষরে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) এএসএম শাহরিয়ার চৌধুরীর বিরুদ্ধে মো. আলী আজগর কর্তৃক আনীত ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় যে অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে এবং এ বিষয়ে গত ২৯ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ১৭তম বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

 

উল্লেখিত অভিযোগগুলো তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ একইভাবে এর আগে প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনের বিষয়ে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, ‘তত্ত¡াবধায়ক প্রকৌশলী (কারখানা সার্কেল, সড়ক ভবন, চট্টগ্রাম) মো. জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য ও আয়বহিভর্‚ত সম্পদ দেশ ও বিদেশে থাকা এবং একটি রাজনৈতিক দলের নেতার নিকট টাকা পাচারের লিখিত অভিযোগ প্রেক্ষিতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির ২৬/০৯/২০২২ খ্রি. তারিখের ১৫তম সভায় বিশদ আলোচনার পর কমিটির সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে তদন্তপূর্বক একটি প্রতিবেদন সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উপস্থাপনের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’

 

জানা গেছে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এ চিঠি পাওয়ার পর সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব উল্লেখিত দুই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের জন্য পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি রিপোর্ট দেয়ার পর তা সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে। দুই প্রকৌশলীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযোগ প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যম অর্জিত অর্থ দিয়ে ঢাকার রামপুরায় ৮তলা একটি বাড়ি, রাজধানীর আফতাবনগর, ধানমন্ডি, লালমাটিয়াসহ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় নামে-বেনামে ১৭টি ফ্ল্যাট, বেগমপাড়া হিসেবে খ্যাত কানাডার টরন্টোয় একটি বাড়ি রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের কাছে টাকা পাচারের অভিযোগ উঠেছে।

 

প্রকৌশলী জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনায় তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় শতকোটি টাকা। অথচ ষষ্ঠ গ্রেডে তার বেসিক বেতনকাঠামো ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা। তবে তিনি প্রতি মাসে বেতন পান ৮০ হাজার টাকার কাছাকাছি। এ বিবেচনায় তার আয়ের থেকে সম্পদের পরিমাণ বেশি! তাছাড়া প্রতি মাসে ৮০ হাজার টাকা বেতন হিসাবে বোনাসসহ বছরে আয় প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টাকা। এ হিসাবে সপদে থেকে ৩০ বছরে অবসরে যাওয়া পর্যন্ত তার মোট আয় দাঁড়াবে প্রায় সাড়ে ৩ কোটি টাকা। অথচ চাকরির অর্ধেক মেয়াদেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের এ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে প্রায় শতকোটি টাকার সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার অভিযোগ উঠেছে।

 

তবে তার অর্জিত সম্পদের সবকিছুই নিজ নামে নয়। নামে-বেনামে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়।’ প্রতিবেদনে বলা হয়, অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছাত্রজীবনে বুয়েটে পড়ার সময় তিতুমীর হল শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এ জামাল উদ্দিন। এ কারণে তিনি প্রায়ই সড়ক বিভাগে কর্মরত বিএনপিপন্থি কর্মকর্তাদের নিয়ে রাজধানীর তেজগাঁও লিংক রোডের একটি রেস্টুরেন্টে বৈঠক করেন। জামাল উদ্দিনের শ^শুরবাড়িও যশোরে। শ^শুরবাড়ির সবাই বিএনপিপন্থি। তার শ^শুর বিএনপির সমর্থনে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। তার সঙ্গে বিএনপির অন্যতম শীর্ষনেতা তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে বলে অভিযোগ আছে। ২০১৪ সালে তিনি তারেক রহমানকে প্রায় ৬ কোটি টাকা দিয়ে সহযোগিতা করেছিলেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, রামপুরার বনশ্রীর ৪ নম্বর সড়কের এফ-বøকে, ১৩ নম্বর বাড়িটি তার। নির্মাণাধীন আটতলা বাড়ির পুরো কাজ প্রায় শেষ হওয়ার পথে। এখন প্লাস্টার আর ইন্টেরিয়র ডিজাইন, পাইপলাইন ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন স্থাপনের কাজ চলমান। জানা গেছে, তিনি ২০১৬ সালে এ বাড়িটি সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরুর কাছ থেকে কিনেছেন। বাড়িটি তার শাশুড়ির নামে রেজিস্ট্রি করান বলে জানা গেছে। এছাড়া বনশ্রীর বি-বøকের ৪ নম্বর সড়কের ৩৭ নম্বর বাড়িতে থাকে জামাল উদ্দিনের পরিবার। ‘বায়তুল হোসাইন নূর’ নামের এ ভবনের চারতলার জে-চার নম্বর ফ্ল্যাটটি তার নিজের টাকায় কেনা।

 

অভিযোগ আছে, রাজধানীর আফতাবনগর এম-বøকের ২ নম্বর রোডে একটি ও জে-বøকের ৩ নম্বর সড়কে আরেকটি প্লটসহ ধানমন্ডির ১৫ নম্বরে ২টি, ধানমন্ডির ২৭ নম্বরে ২টি, কল্যাণপুরে ১টি, লালমাটিয়ার জাকির হোসেন রোডে ২টি, মিরপুর মাজার রোডে ১টি, মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বরের ডান পাশে ২টি, গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বরের বাম পাশের পোস্ট অফিসের কাছে ১টি, বনানী জে-বøকের ১৮ নম্বর রোডে ১টি, উত্তরা ১৩ নম্বর সেক্টরের ৫ নম্বর সড়কে ১টি ফ্ল্যাট এবং যশোর নড়াইল মহাসড়কের পাশে ৩০ একর জমি রয়েছে। দেশের বাইরে কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়ায়ও জামাল উদ্দিনের বাড়ি থাকার অভিযোগ মিলেছে। সেখানে তার একটি সুরম্য বাড়ি রয়েছে, যা থেকে তিনি প্রতি মাসে ৩ হাজার কানাডিয়ান ডলার ভাড়া পান বলে জানা গেছে।

 

এ বাড়িটি তিনি সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জর্জেস হোসেনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কেনেন। আর প্রকৌশলী এএসএম শাহরিয়ারের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে নামে-বেনামে খুলনা শহরে ১৪টি, ফরিদপুর শহরে ৫টি ফ্ল্যাট, ঢাকার মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধের পূর্ব পাশে ১টি ৬তলা বাড়ি, বরিশাল-পটুয়াখালী রোডে টিয়াখালী এলাকায় ২২ একর জায়গার ওপর একটি মাছের খামার, খুলনা-সাতক্ষীরা জিলেরডাঙ্গা এলাকায় ৯৪ একর জায়গায় দুটি মাছের ঘের করার অভিযোগ রয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version