-->
বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ

ক্রমেই ভয়াবহ হচ্ছে প্লাষ্টিক দূষণ

শাহীন রহমান
ক্রমেই  ভয়াবহ হচ্ছে প্লাষ্টিক দূষণ

শাহীন রহমান: বিশ্ব পরিবেশ দিবস আজ। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি গুরুত্ব দিয়ে পালনের কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এবার পরিবেশ দিবসের কর্মসূচিতে প্লাষ্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের কথা বলা হয়েছে।

 

জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির ঘোষণা ‘প্লাস্টিক দূষণ সমাধানে শামিল হই সকলে’ প্রতিপাদ্যে এবং ‘সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’ স্লোগানে দেশে বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালন করা হবে বলে জানিয়েছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্লাষ্টিক দূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এই দূষণের সরাসরি প্রভাব পড়ছে বঙ্গোপসাগরে। দেশে বিভিন্ন নদী দিয়ে প্লাস্টিক বর্জ্য সরাসরি পড়ছে বঙ্গোসাগরে। শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়ে ব্যাপকভাবে বাড়ছে প্লাস্টিকের ব্যবহার, যা ড্রেনেজ ব্যবস্থায় বিঘ্ন তৈরি থেকে শুরু করে মহাসমুদ্র পর্যন্ত দূষিত করে দিচ্ছে। আর এই সমুদ্রে নদীবাহিত প্লাস্টিক দূষণে দায়ী দেশগুলোর তালিকায় নবম স্থানে আছে বাংলাদেশ।

 

সম্প্রতি এক গবেষণায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। সায়েন্স অ্যাডভান্সে প্রকাশিত গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। নেদারল্যান্ডস, জার্মানি ও নিউজিল্যান্ডের সাত গবেষকের করা এই গবেষণা বলছে, সমুদ্রের প্রায় ৮০ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য আসে পৃথিবীর এক হাজারের বেশি নদী থেকে। এর একটি বড় অংশ আসে এশিয়ার নদীগুলো থেকে।

 

গবেষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নদীগুলো বছরে প্রায় ২৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে নিয়ে যায়। বিশেষ করে ভারত ও বাংলাদেশের গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনা বেসিন, কর্ণফুলী ও রূপসা নদী থেকে সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক বর্জ্য যায় বঙ্গোপসাগরে। পদ্মা দিয়ে বছরে প্রায় সাত হাজার টন, কর্ণফুলী দিয়ে প্রায় তিন হাজার টন এবং রূপসা দিয়ে প্রায় ১ হাজার ৪০০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রে গিয়ে পড়ে।

 

শুধু সমুদ্র নয়, প্লাষ্টিকের কারণে দেশে অধিকাংশ নদীও এখন ভয়াবহ দূষণের শিকার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিল্পকারখানা এবং শহরের পয়োবর্জ্য সরাসরি ফেলা হচ্ছে নদীতে। বুড়িগঙ্গা-কর্ণফুলীর মতো একসময়ের টলটলে পানির নদীগুলো এ কারণে এখন মারাত্মক দূষণের শিকার। দেশের অন্য নদীগুলোরও দূষণের চিত্র প্রায় একই।

 

সাম্প্রতিক কিছু গবেষণায় বলা হয়েছে, প্লাষ্টিকের কারণে নদীদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজধানীর চারপাশের চারটি নদীতে ৩০ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্যে ভরে আছে। তবে প্লাস্টিকের কারণে সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার বুড়িগঙ্গা নদী। জাতিসংঘের পরিবেশবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বুড়িগঙ্গা বিশ্বের অন্যতম দূষিত নদী।

 

বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত তথ্যা অনুযায়ী, প্লাস্টিক দূষণের দিক থেকে গঙ্গা, পদ্মা, যমুনা যৌথভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় দূষিত অববাহিকা হিসেবে চিহ্নিত।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্লাষ্টিক পণ্যের ব্যবহার যেমন বাড়ছে, তেমনি দূষণের তালিকায় নতুন নাম যোগ হয়েছে এই প্লাস্টিক দুষণ। গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে প্লাষ্টিক দূষণের হার আশপাশের দেশের তুলনায় অনেক বেশি। এই দূষণের হারও উত্তরোত্তর বাড়ছে। প্লাষ্টিকের এই দূষণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করছে মৎস্য উৎপাদন এবং পর্যটন খাতকে।

 

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈশ্বিক মোট প্লাস্টিক দূষণের ২.৪৭ শতাংশ বাংলাদেশে হয়ে থাকে। তিনি বলেন, পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে আইন করা হলেও কার্যকর প্রয়োগের অভাবে প্লাস্টিক থেকে পরিবেশ দূষণ শুধু অব্যাহতই নয়, বরং উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। প্লাস্টিক বর্জ্যসহ ব্যাপকভাবে বর্জ্য ফেলার কারণে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু, শীতলক্ষ্যা ও কর্ণফুলী নদী দেশের অন্যতম দূষিত নদীতে পরিণত হয়েছে। প্লাস্টিক দূষণের কারণে গাছপালা ও অন্যান্য প্রাণীর অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। এ ছাড়া জৈব রাসায়নিক সারে প্রচুর পরিমাণে মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকায় তা কৃষিকাজে ব্যবহারের ফলে স্থায়ীভাবে মাটি দূষিত হচ্ছে।

 

সম্প্রতি সমীক্ষায় দেখা গেছে, দেশে বিশেষ করে কসমেটিকস প্লাস্টিক, গৃহস্থালির প্লাস্টিক এবং বাণিজ্যিক কাজে প্লাস্টিকের ব্যবহার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের চেয়ে ইথানিলযুক্ত পলিথিন ব্যবহারের পরিমাণ দেশে তুলনামূলকভাবে বেশি। ছোট থেকে বড় যে কোনো পণ্য প্যাকিংয়ে পলিথিনের ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে। ব্যবহৃত এসব পলিথিনের শেষ ঠাঁই হচ্ছে নর্দমা, খাল, নদী প্রভৃতি স্থানে। পলিথিনের অনিয়মিত ব্যবস্থাপনা ঢাকা শহরের ৮০ শতাংশ জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।

 

২০১৪ সালের ওয়েস্ট কর্নসানের তথ্যে উল্লেখ করা হয়েছে বাংলাদেশে মাথাপিছু সাড়ে তিন কেজি প্লাস্টিকের ব্যবহার রয়েছে। যদিও পার্শ্ববর্তী শ্রীলঙ্কায় এই হার ৬ কেজির বেশি। কিন্তু দূষণের দিক দিয়ে আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে প্লাস্টিক দূষণের পরিমাণ বেশি। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে বাংলাদেশে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তুলনামূলক খারাপ হওয়ায় পচনশীল এবং অপচনশীল আলাদা করার সঠিক ব্যবস্থাপনা নেই।

 

ফলে অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্য মাটিতে থেকে যাচ্ছে বছরের পর বছর। এছাড়াও নদীমাতৃক এবং ভাটির দেশ হওয়ায় উজানে পানির সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে প্লাস্টিক বর্জ্য দেশের নদীগুলো দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সাগরে পতিত হচ্ছে। ফলে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার কম হলেও দূষণের পরিমাণ বেড়েই চলছে।

 

বিজ্ঞানীর বলছেন, সাগর ও নদীতে ফেলা প্লাস্টিক বর্জ্যগুলো টুকরো টুকরো হয়ে মাছের খাবারের মাধ্যমে মানবদেহেও প্রবেশের আশঙ্কা থাকে। জলজ প্রাণী এসব খাবার হজম করতে না পেরে মারা যাচ্ছে।

 

প্লাস্টিক দূষণের প্রভাবে উদ্ভিদ এবং জলজ প্রাণীর পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতি হচ্ছে মানব স্বাস্থ্যের। মানবদেহে থায়রয়েডের হরমোন অতিরিক্ত ক্ষরণ এবং বিশেষ করে ক্যান্সার, চর্মরোগ, কিডনি রোগের মতো ভয়াবহ রোগ সৃষ্টির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী এই প্লাস্টিক বর্জ্য।

 

বিশেষজ্ঞরা জানান, শুধু রাজধানী ঢাকায় দৈনিক ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি পলিথিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

 

স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও পরিবেশ গবেষক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, মাটির অনুজীব মাটিতে মিশে যাওয়া প্লাস্টিক বর্জ্য পচাতে পারে না। এটি আবহাওয়া প্রভাবিত হয়ে দীর্ঘমেয়াদে ছোট ছোট টুকরো হয়ে বাতাসে বা পানিতে মিশতে থাকে, যা পরবর্তী সময়ে পরিবেশ বা প্রাণিজগতের জন্য বিপর্যয় ডেকে আনে।

 

এদিকে এবার পরিবেশ দিবসের প্লাষ্টিক দূষণ নিয়ন্ত্রণের ওপর জোর দেয়া হয়েছে বিশ্বব্যাপী। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও প্লাষ্টিক দূষণ কমিয়ে আনতে কর্মপরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।

 

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, প্লাস্টিক দূষণ রোধে দশ বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে। সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক বন্ধে তিন বছর মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে।

 

সুন্দরবনসহ অন্যান্য বনভূমিতে যাতে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক দ্বারা কোনো দূষণ না হয়, সে বিষয়ে কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

 

মন্ত্রী বলেন, সুষ্ঠুভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়েছে।

 

পরিবেশ দিবসের কর্মসূচি: এদিকে আজ বিশ্ব পরিবেশ দিবস যথাযথভাবে পালনের জন্য বিস্তারিত কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে আজ সকাল সাড়ে ৯টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবনে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে কর্মসূচির শুভ উদ্বোধন করবেন। শেরেবাংলা নগরে অনুষ্ঠিতব্য পরিবেশ মেলা চলবে ৫ জুন থেকে ১১ জুন পর্যন্ত।

 

২৭ থেকে ৩০ জুন ঈদুল আজহার সরকারি ছুটি থাকায় বৃক্ষমেলা চলবে ৫ থেকে ২৬ জুন এবং ১ থেকে ১২ জুলাই ২০২৩ পর্যন্ত। প্রতিদিন মেলা চলবে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৮টা পর্যন্ত। পরিবেশ বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version