logo
আপডেট : ২৬ মে, ২০২৩ ১২:০৭
বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি অর্জন
সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ
ড. মিল্টন বিশ্বাস

সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের বিশ্বে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছি আমরা। কারণ যুদ্ধের বিশ্বে শান্তির ললিত বাণী মানুষকে আতঙ্ক থেকে রক্ষার জন্য খুব বেশি কাজে লাগতে পারে। যুদ্ধজনিত সংকট থেকে সমগ্র মানবসমাজকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে মহাঐক্য তৈরির প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি হচ্ছে।

 

ক্ষতিগ্রস্ত রাষ্ট্রের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে আরেক রাষ্ট্রকে, মানুষের জন্য সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে আরেক মানুষকে। বিশ্বনেতাদের সম্মিলিতভাবে আতঙ্ক মোকাবিলার প্রত্যয় ঘোষণা জরুরি হয়ে পড়েছে যেখানে দুর্দশায় পতিত মানবজাতিকে উদ্ধারের জন্য নিজের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করা দরকার মনে করছেন সবাই এসবই ছিল বঙ্গবন্ধুর মধ্যে।

 

এ জন্যই বিশ্ব শান্তি পরিষদ বিশ্বের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকে ভূষিত করে ‘বিশ্ববন্ধু’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। বাংলাদেশ অভ্যুদয়ের পর বিশ্বশান্তি পরিষদের সর্বোচ্চ পুরস্কার এই জুলিও কুরি শান্তি পদক। সাম্য-মৈত্রী, গণতন্ত্র রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জীবদ্দশাতেই বিশ্বশান্তি পরিষদের পক্ষ থেকে পাওয়া এই পুরস্কার বঙ্গবন্ধু উৎসর্গ করেছিলেন বাংলাদেশ তথা তৃতীয় বিশ্বের অসহায় মানুষদের।

 

বাংলাদেশ সংবিধানের ২৫নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত হয়েছে বঙ্গবন্ধু গৃহীত পররাষ্ট্রনীতিসমূহ, যা তাকে শান্তির দিশারি হিসেবে গণ্য করে।

 

যেমন- জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অপর রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান এবং আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদে বর্ণিত নীতিসমূহের প্রতি শ্রদ্ধা এসব নীতিই রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি।

 

বাংলাদেশ রাষ্ট্র সর্বদা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকা এবং সাধারণ ও পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য চেষ্টা করবে; প্রতিটি জাতির স্বাধীন অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবে; এবং সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ বা বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে।

 

সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদে যুদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত নীতি উল্লেখ করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে সংসদের সম্মতি ব্যতীত যুদ্ধ ঘোষণা করা যাবে না, কিংবা প্রজাতন্ত্র কোনো যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে না। ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে যোগদান করেন তিনি। ওই সফরে বঙ্গবন্ধু অনেক দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলেন।

 

তা ছাড়া ওই সম্মেলনেই ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহব্বান জানান তিনি। ওই সম্মেলনে ৮ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি শুরুতেই জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশের যেসব গণমানুষ শহীদ হয়েছে, তাদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম আজো অব্যাহত ভিয়েতনাম, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, নামিবিয়া, গিনি বিসাউসহ লাতিন আমেরিকা ও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। তাই একটি বৈষম্যহীন পৃথিবী গড়তে আমাদের সবাইকে এক হয়ে শোষিতের পক্ষে দাঁড়াতে হবে।’

 

পরদিন ৯ সেপ্টেম্বর বিদায়ী ভাষণেও বঙ্গবন্ধু বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা ও পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর জোর দেন। অন্যদিকে পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মুসলিম দেশগুলোর জোট ওআইসির সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন এবং বাংলাদেশকে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য করতে পিছু হটেননি বঙ্গবন্ধু।

 

সেখানে তিনি বলেছিলেন, ‘আমি বলতে চাই, সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে। আমরা এই উপমহাদেশে এবং বিশ্বে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে যুগপৎ অবদান রাখার পথ উন্মুক্ত করেছি।’ ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধু বিশ্বের অধিকারহারা শোষিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মূল্যবান ভাষণ দেন।

 

১৯৭৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সর্বসম্মত অনুমোদনক্রমে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। এর কয়েক দিন পর ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বক্তৃতা করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শান্তি স্থাপনে বঙ্গবন্ধুর অভিমতসমূহের কিছু অংশ নিম্ন রূপ-

 

ক) ‘বাংলাদেশ প্রথম হইতেই শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান ও সবার প্রতি বন্ধুত্ব এই নীতিমালার ওপর ভিত্তি করিয়া জোট নিরপেক্ষ নীতি গ্রহণ করিয়াছে। কেবল শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই কষ্টলব্ধ জাতীয় স্বাধীনতার ফল ভোগ করিতে আমাদের সক্ষম করিয়া তুলিবে এবং সক্ষম করিয়া তুলিবে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, রোগ, অশিক্ষা ও বেকারের বিরুদ্ধে লড়াই করিবার জন্য আমাদের সব শক্তি ও সম্পদকে সমাবেশ ও কেন্দ্রীভূত করিতে। এই ধারণা হইতে জন্ম নিয়াছে শান্তির প্রতি আমাদের প্রতিশ্রুতি।

 

এ জন্য সমঝোতার অগ্রগতি, উত্তেজনা প্রশমন, অস্ত্র সীমিতকরণ এবং শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতির সম্প্রসারণের লক্ষ্যে এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা বিশ্বের যেকোনো অংশে যেকোনো প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হউক না কেন, আমরা তাহাকে স্বাগত জানাই। এই নীতির প্রতি অবিচল থাকিয়া আমরা ভারত মহাসাগরীয় এলাকা সম্পর্কে শান্তি এলাকার ধারণা, যাহা এই পরিষদ অনুমোদন করিয়াছে, তাহাকে সমর্থন করি। আমরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে শান্তি, স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ এলাকায় পরিণত করার প্রতিও সমর্থন জানাই।’

 

খ) ‘বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় আমাদের অঙ্গীকার প্রমাণের জন্য উপমহাদেশে আপস-মীমাংসার পদ্ধতিকে আমরা জোরদার করিয়াছি। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশের অভ্যুদয় বস্তুতপক্ষে এই উপমহাদেশে শান্তি কাঠামো এবং স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অবদান সৃষ্টি করিবে। ইহা ছাড়া আমাদের জনগণের মঙ্গলের স্বার্থেই অতীতের সংঘর্ষ ও বিরোধিতার পরিবর্তে মৈত্রী ও সহযোগিতার সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে।’

 

গ) ‘শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান, সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখন্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা এবং অন্যের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিবেশী সব দেশের সঙ্গে সৎপ্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক বজায় রাখিবে। আমাদের অঞ্চলে এবং বিশ্বশান্তির অন্বেষার সব উদ্যোগের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকিবে।’

 

বঙ্গবন্ধুকে কেন ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পুরস্কার প্রদান করা হয়েছিল তার ব্যাখ্যা দেয়ার জন্য উপরের বিবরণ প্রয়োজন ছিল। কারণ এই শান্তি পদক এক অসামান্য কীর্তির স্মারক, মর্যাদা ও বিশ্বশান্তির প্রতীক। মূলত বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ছিল জোট নিরপেক্ষ নীতি এবং শান্তি ও ন্যায়ের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ।

 

তিনি বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম শক্তি যে অর্থ ব্যয় করে মানুষ মারার অস্ত্র তৈরি করছে, সেই অর্থ গরিব দেশগুলোকে সাহায্য দিলে পৃথিবীতে শান্তি প্রতিষ্ঠা হতে পারে।’

 

বঙ্গবন্ধু ছিলেন আফ্রো-এশিয়া-লাতিন আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা। ১৯৭১ এর পর গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে একটি নতুন দর্শন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংঘাতময় পরিস্থিতির অবসানে তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পৃথিবীব্যাপী হত্যাযজ্ঞের অভিজ্ঞতা থেকে প্রবর্তিত এই ‘জুলিও কুরি’ পদক শান্তি প্রতিষ্ঠায় উৎসর্গিত হয়েছিল; পারমাণবিক বোমা আর মারণাস্ত্রের মহড়া থেকে রাষ্ট্রগুলোকে দূরে রাখার জন্যও। যারা পুরস্কৃত হয়েছিলেন তারা কেউই সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর তাবেদার ছিলেন না। হিংস্র কিংবা আধিপত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেননি ওই ব্যক্তিবর্গ।

 

বরং আজীবন তারা মানবিক বিশ্ব গড়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ‘জুলিও কুরি’ শান্তি পদকপ্রাপ্তির সুবর্ণজয়ন্তীর এই দিন স্মরণের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মকে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল আদর্শের শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। বিশ্বশান্তি ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় জাতির পিতার অবদানকে সামনে আনলে যেকোনো সংকট মোকাবিলায় ভবিষ্যতেও আমরা সক্ষম হবো।

 

লেখক : অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

 

ভোরের আকাশ/নি