logo
আপডেট : ২১ মে, ২০২৩ ১৭:০৪
মাতলামি ও বউ পেটানোর অভিযোগ পুরোনো
নোবেলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
রুদ্র মিজান

নোবেলের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

রুদ্র মিজান: মাইনুল আহসান নোবেল। শিল্পী নোবেল হিসেবেই পরিচিত। অন্য তারকাদের চেয়ে যেন সম্পূর্ণ ভিন্ন একজন। নিয়ম ভাঙার নিয়মে যেমন পারদর্শী, তেমনি সবকিছুতেই যেন ডেমকেয়ার তিনি। কাউকে পরোয়া করেন না। মুহূর্তেই অবস্থান পরিবর্তন করতেও পটু। কর্ম-অপকর্ম করে আলোচনায় থাকাই যেন তার কাজ।

 

ধরা-বাঁধা নিয়মের বাইরে এক ভিন্ন মানুষের নাম নোবেল। অভিযোগের শেষ নেই তার বিরুদ্ধে। মাতলামি, বউ পেটানো, নারীসহ হোটেলে বিশৃঙ্খলা, প্রতারণা, গান চুরি- এমন অভিযোগ অনেক। নোবেলের শুরুটাই ভিন্ন রকম। গোপালগঞ্জে জন্ম। বাবা মোজাফফর হোসেন নান্নু একজন ব্যবসায়ী। শৈশবে বিদ্যালয় পরিবর্তন করেছেন বারবার। ঢাকা, খুলনা, গোপালগঞ্জের বিভিন্ন স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল তাকে। যেন বছরে বছরে স্কুল পরিবর্তন। স্কুলও ছাড়তে হয়েছিল অপকর্মের কারণে। সহপাঠীদের সঙ্গে মারধর করে গোপালগঞ্জের স্কুল ছাড়তে হয় তাকে। একপর্যায়ে দেশ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে। বেছে নেন ইংলিশ মিডিয়াম। দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে ভর্তি হন নোবেল। তারপর ভর্তি হন কলকাতার হাজরার একটি স্কুলে। ওই সময়ে গীটারকে সঙ্গী গানে মনোযোগী হন তিনি। সহযোগিতা করেন বন্ধুরা। অবশ্য শৈশব থেকেই এ প্রতিভার প্রকাশ ঘটছিল নানাভাবে। ২০১৪ সালে এ-লেভেল দেয়ার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেশে ফেরেন। পরিবারের সবাইকে জানিয়ে দেন, তিনি শিল্পী হতে চান।

 

পরিবারের সবাই বাধা দিলেও তোয়াক্কা করেননি নোবেল। নোবেলের ভাষায় এটি চরম কষ্টের সময়। আত্মীয়স্বজন, পরিচিতজনদের কাছে জুটেছে তার নামের আগে বখাটে তকমা। তারপরও সংগ্রাম করে করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। ২০১৮ সালে অংশ নেন কলকাতার জি বাংলার রিয়েলিটি শো ‘সারেগামাপা’তে। জেমস, আইয়ুব বাচ্চুর গান গেয়ে কাঁপিয়ে দেন তিনি। রাতারাতি অর্জন করেন তুমুল জনপ্রিয়তা। ‘সারেগামাপা’তে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন বাংলাদেশের এ শিল্পী। ওই সময়ে জনপ্রিয়তার পাশাপাশি চুরির তকমা জুটিয়েছেন তিনি। নোবেলের বিরুদ্ধে গান চুরির অভিযোগ করেন ভারতীয় সংগীত পরিচালক সৈকত চট্টোপাধ্যায়। নোবেলের নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত ‘বাংলা মিলবে কবে’ গানের গীতিকার ও সুরকার সৈকত চট্টোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, লিখিত চুক্তি ছাড়াই তার লেখা ও সার করা গানটি প্রকাশ করেছেন নোবেল। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক কপিরাইট আইনে গানের মূল স্বত্ব গীতিকার ও সুরকারের। প্রচলিত কপিরাইট আইনে, সুরকার ও গীতিকারের অনুমতি ছাড়া কোনো গান প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের ৭১ ধারার লঙ্ঘন মর্মে ৮২ ধারায় সর্বোচ্চ ৫ বছর কারাদণ্ড ও সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকার অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে। এ ঘটনাকে ভারতীয় সংগীত পরিচালক ‘চুরি’ উল্লেখ করে ফেসবুকে লেখেন, ‘নোবেলম্যানের নোবেল চুরি। স্রষ্টার সার্বিক অনুমতি ছাড়াই একজন শিল্পী স্রষ্টার গান কীভাবে প্রকাশ করতে পারে? হতে পারে প্রাথমিক স্তরে কথা হয়েছিল তার গানটা গাওয়া নিয়ে, যেরকম অনেকের সঙ্গেই হয়ে থাকে।...’

 

একইভাবে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে নোবেলের বিরুদ্ধে গান চুরির অভিযোগ তোলে ব্যান্ডদল ‘অ্যাবাউট ডার্ক’। ফেসবুকে ব্যান্ডদলটির গিটারিস্ট ও গানটির লেখক নাসির উল্লাহর এক অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে পরদিনই ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব থেকে গানটি সরিয়ে ফেলেন নোবেল।

 

‘অ্যাবাউট ডার্ক’ ব্যান্ডদলের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য এরফান আহমেদ পূর্ণ অভিযোগ করে ওই সময়ে বলেন, ‘অ্যাবাউট ডার্ক’ ব্যান্ড প্রতিষ্ঠার সময় ২০১৬ সালে নোবেল আমাদের ব্যান্ডে যোগ দেয়। ব্যান্ডের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আত্মসাতের অভিযোগে তাকে ব্যান্ড থেকে কিছুদিন পরই বের করে দেয়া হয়। সম্প্রতি নোবেল যে গানটি নিজের বলে প্রকাশ করেছে, গানটি ২০০৫ সালে নাসির উল্লাহর লেখা। নোবেল এ গানটি নিজের দাবি করে প্রকাশ করেছিল। নোবেল শৈশব থেকে ‘জেমস’ হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারকা শিল্পী হওয়ার পর জেমসকে নিয়ে যা-তা বলতে ছাড়েননি তিনি। ২০২১ সালের ১৪ মে। নগর বাউল জেমসকে নিয়ে এক রাতেই ১৭টি পোস্ট দেন।

 

এতে তিনি লেখেন, ‘বেটা বয়স হইছে। এবার বাদ দে গান বাজনা। বহুত করসোস।’ ‘জেমসকে ওপেন চ্যালেঞ্জ, একই গান জেমস গাবে, আমিও গাবো।’ ‘কর বেটা মামলা কর, একটু জেল খাটি’ ইত্যাদি। অবশ্য পরে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজের বোল পাল্টান তিনি।

 

মদ পান করে মাতাল হয়ে মারধর করা। হোটেলে নারীসহ উঠে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের আগস্টের ঘটনা। এক নারীসহ বান্দরবান সদরের থানচির আবাসিক হোটেল গার্ডেন সিটিতে ওঠেন নোবেল। হোটেল থেকে বের হয়ে নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। এলাকাবাসীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। রাত ১২টায় মদ্যপ অবস্থায় হোটেলের অভ্যর্থনা কক্ষে গিয়ে চিৎকার ও চেঁচামেচি শুরু করেন। ওই সময়ে হোটেলের এক বর্ডারকে মারধর করেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঘটনাস্থলে পুলিশ পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

 

ওই হোটেলের মালিক মো. জাফর জানান, তিনি খুবই অসভ্য আচরণ করেছেন। এমনকি তিনি তথ্য গোপন করে স্ত্রী পরিচয় দিয়ে একজন নারীকে নিয়ে হোটেলে উঠেছেন। পরদিন তাকে নিজের বোন বলে দাবি করেছেন। ওই সময়ে (২৫ আগস্ট) নিজের ফেসবুক পেজে একটি ছবি প্রকাশ করেন নোবেল। এতে তিনি লেখেন, ‘গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায় ও মিরাবই...।’ ছবিতে দেখা গেছে, দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের নাফাকুম জলপ্রপাতের পাশে এক নারীর সঙ্গে বসে এক ধরনের নেশাদ্রব্য গ্রহণ করছেন নোবেল। এ ঘটনায় ওইসময় ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করেন নোবেলের স্ত্রী সালসাবিল। দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আরাভ খানের অর্থায়নে একটি ব্যয়বহুল অ্যালবাম করারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন নোবেল। দুবাইয়ে আরাভ খানের স্বর্ণের দোকানে উদ্বোধনেও যান তিনি।

 

গত ২৭ এপ্রিল মধ্যরাতে কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী ডিগ্রি কলেজের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে লঙ্কাকাণ্ড ঘটান নোবেল। রাত ১১টার পর অনুষ্ঠানের মূল চমক হিসেবে মঞ্চে ওঠে অস্বাভাবিক আচরণ করতে শুরু করেন। কখনো নিজের চোখের সানগ্লাস পাঞ্জাবির বুকে ঝুলিয়ে সেটি খুঁজে হয়রান, কখনো মাইক্রোফোন স্ট্যান্ডটিকে আছড়ে ফেলছেন। কখনো মঞ্চের ওপর সজোরে লাথি হাঁকান। আর কণ্ঠে জড়িয়ে যাওয়া গানের কথা-সুর। গাইতে গাইতে বসেও পড়েন মঞ্চে। ওইসময় দর্শকরা জুতা, পানির বোতল ছুড়ে আর ভুয়া ধ্বনিতে প্রতিবাদ করেন।

 

সর্বশেষ মো. সাফায়েত ইসলাম নামে এক ব্যক্তির প্রতারণার মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে এখন রিমান্ডে শিল্পী নোবেল। মামলায় তার বিরুদ্ধে অনুষ্ঠানে না গিয়ে ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ করা হয়। গত ১৬ মে শরীয়তপুরের ভেদরগঞ্জ হেডকোয়ার্টার পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ‘এসএসসি ব্যাচ ২০১৬’ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার জন্য মাইনুল আহসান নোবেলের সঙ্গে ১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা ঠিক করা হয়। এরপর নোবেলকে বিভিন্ন সময়ে ব্যাংক অ্যাকাউন্টেসহ মোট ১ লাখ ৭২ হাজার টাকা দেয়া হয়। তবে অনুষ্ঠানে না গিয়ে প্রতারণা করে এ অর্থ আত্মসাৎ করেন। মাতলামি, বউ পেটানোর কারণেই নোবেলকে ডিভোর্স দেন সালসাবিল।

 

ভোরের আকাশ/আসা