logo
আপডেট : ১৭ মার্চ, ২০২৩ ১৬:৪২
সাইক্লিস্ট দিলীপ কুমার: সাইকেলের ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখানো যার পেশা
খুলনা ব্যুরো

সাইক্লিস্ট দিলীপ কুমার: সাইকেলের ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখানো যার পেশা

সাইকেলের নৈপূণ্য দেখাচ্ছেন দিলীপ কুমার

ঐতিহ্যবাহী বাংলার দক্ষিণ জনপদের এক প্রতিভাবান সাইক্লিস্টের নাম দিলীপ কুমার রায়। সাইকেলের ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখানো যার পেশা। অত্যন্ত সদালাপী, বিনয়ী ও পরিশ্রমী মানুষ এই দিলীপ। খুলনা জেলার রূপসা থানার অন্তর্গত অখ্যাত একটি গ্রাম পাঁচ আনি। অখ্যাত গ্রামের এক দরিদ্র কিশোর দিলীপ কুমার রায়কে তিন দশক আগে কেউ চিনতো না।

 

নিজ প্রতিভাগুণে তার ভাঙা পুরোনো সাইকেলে চৌকষ ক্রীড়া নৈপূণ্য দেখিয়ে ইতোমধ্যে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেছেন। এ পর্যন্ত হাজারের বেশি প্রদর্শনী করেছেন দেশের বিভিন্ন স্থানে।

 

বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তার নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশে বিদেশে। বর্তমানে দিলীপ ফটো সাংবাদিক হিসেবেও কাজ করছেন। দিলীপের উত্থানের বিষয়ে জানতে তার বাসায় গিয়ে সাইকেলের ক্রীড়া নৈপুণ্যের নানাবিধ দিক নিয়ে কথা হলো। তার বর্ণনানুযায়ী, গ্রামের রিকশা মেরামতকারী বাবা ললিত মোহন রায়ের ১১ সন্তানের মধ্যে সবার বড় দিলীপ।

 

সাইকেল-রিকশা মেরামতকারী পিতার সংসার দারিদ্রের কষাঘাতে জর্জরিত। সংসারের বিরাট বোঝা টানতেই ললিত মোহনের প্রাণান্তকর অবস্থা। ছেলেমেয়েদেরও লেখাপড়া করানো তার কাছে বিলাসিতার শামিল। ৭ বছর বয়সে যখন গাঁয়ের আর ক’জন ছেলেমেয়ের সঙ্গে লেখাপাড়া করার কথা, সেই বয়সে বাবাকে সাহায্য করার জন্য নিতে হলো কচি হাতে লোহা লক্করের কঠিন স্পর্শ। স্বাধীনতার পর জীবিকার তাগিদে বাবা চলে এলেন খুলনা শহরে।

 

পুরাতন হেলিপোর্ট-এর প্রেসক্লাব ভবনের কাছে ছোট্ট একটি ঘরে শুরু করেন সাইকেল-রিকমা মেরামতের কাজ। আগে কিশোর দিলীপ জীবিকার তাগিদে সাইকেল চালানো শিখতে শুরু করেন ছোট্ট হেলিপ্যাডে। অগণিত শিশু-কিশোর যুবককে ভাড়ার মাধ্যমে সাইকেল চালানো শিক্ষা দেয়াই হলো তার মূল পেশা। এর মধ্যে একটি ঘটনা তার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল।

 

১৯৭৪ সালে রাস্তার পাশে লোকজনের ভিড় দেখে কৌতুহলী কিশোর দিলীপ এগিয়ে গেল। অবাক হয়ে দেখলো একজন লোকের সাইকেল নিয়ে ক্রীড়া নৈপূণ্য। ঘটনাটি দারুণ প্রভাব ফেলে কিশোর দিলীপের মনে। সাইকেল চালানো শেখানোর ফাঁকে ফাঁকে রাতদিন শুরু হলো তার কঠিন অধ্যাবসায় অনুশীলন। ধীরে ধীরে আয়ত্তে আসলো সাইকেল নিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গির খেলার কৌশল।

 

এক আধটু করে জনসম্মুখে প্রদর্শন শুরু করলেন তার ক্রীড়াশৈলী। এমনিভাবে দিন-মাস-বছর পেরিয়ে সে হয়ে উঠলো দক্ষ পরিণত সাইক্লিস্ট। এর মধ্যে সে সারা খুলনা শহরসহ আশপাশের জেলাগুলো ছাপিয়ে তার সাইকেল খেলা প্রদর্শন শুরু করল রাজধানীসহ সারা দেশে। নাম ডাক পড়ে গেল গ্রাম বাংলার আনাচে কানাচেসহ প্রতিটি ঘরে।

 

ইতোমধ্যে তিনি রপ্ত করেছেন প্রায় শতাধিক বিভিন্ন রকম খেলা। প্রদর্শনী করেছে হাজারেরও বেশি। সার্টিফিকেটও অর্জন করলো বেশ কিছু। ক্রীড়া নৈপুণ্যের মধ্যে রয়েছে চলন্ত সাইকেলে দাঁড়িয়ে একটি শিশুকে নিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়া নৈপূণ্য। চারটি শিশুকে শুইয়ে নিয়ে সাইকেল চালানো। ৩টি কাঁচের গ্লাসের ওপর সাইকেল প্রদর্শন। ৫টি সাইকেল নিয়ে ক্রীড়া, ব্যাক ফ্রন্ট থেকে তিনটি সাইকেল এক সঙ্গে চালানো ইত্যাদি।

 

সাইক্লিস্ট দিলীপ কুমার রায়ের চিত্তাকর্ষক সাইকেল ক্রীড়াশৈলী কোটি কোটি হৃদয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। অসংখ্য ক্রীড়ায় খ্যাতি অর্জনসহ বিভিন্ন জাতীয় গণমাধ্যমে স্বচিত্র প্রতিবেদন প্রচার ও প্রকাশ পেয়েছে ইতোমধ্যে। শৈলীচিত্র প্রদর্শনে সার্বিক ব্যবস্থা দানে সহানুভ‚তি স্পন্সর ও পৃষ্টপোষকতা চান তিনি।

 

তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান ও যেসব অনুষ্ঠানে বিভিন্নস্থানে সাইকেল ক্রীড়াশৈলী প্রদর্শন করেছেন তার মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কুল কলেজ মাদরাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও বিনোদনমূলক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠানে শোভাযাত্রা, বর্ণাঢ্য র‌্যালি, বাংলাদেশ নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী, বাংলাদেশ আনসার ভিডিপি, গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, বিভিন্ন সেবামূলক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য-শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর মধ্যে অন্যতম। ক্রীড়ায় বিভিন্ন সনদপত্র সার্টিফিকেট অর্জনসহ জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত হয়েছেন। ব্যক্তিগত জীবনে দিলীপ কুমার রায় বিবাহিত, ১ সন্তানের জনক।

 

ক্রীড়াই তার জীবন। এছাড়া ক্যারাম খেলায়ও তুখোড় পারদর্শী দিলীপ কুমার রায়। আর্থিক দৈনতা থাকা সত্তে¡ও মানব সেবার সুযোগ পেলে এগিয়ে আসেন দিলীপ। এর প্রমাণ হিসাবে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ¡াসে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যার্থে দিলীপ কুমার রায় বিভিন্ন প্রদর্শনীর মাধ্যমে অর্জিত সমুদয় অর্থ প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে দান করেন।

 

দিলীপ কুমার রায়ের সঙ্গে তার পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, সাইকেলের ক্রীড়া নৈপুণ্য শেখানোর জন্য এখন একটি প্রতিষ্ঠান খুলতে চান তিনি, এছাড়া শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণের জন্য তার ব্যাপক আগ্রহ রয়েছে। তিনি জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, স্পন্সর পেলেই গড়ে তুলতে পারেন প্রশিক্ষণ সেন্টার ও মিউজিয়াম গ্যালারি।

 

ভোরের আকাশ/নি