logo
আপডেট : ২৪ জানুয়ারি, ২০২৩ ১৯:৩৪
ডাকাত থেকে জঙ্গি নেতা রনবীর
পাহাড়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া জঙ্গিদের খোঁজে র‌্যাব
নিজস্ব প্রতিবেদক

পাহাড়ে প্রশিক্ষণ পাওয়া জঙ্গিদের খোঁজে র‌্যাব

পাহাড়ের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনফের প্রশিক্ষণ পাওয়া জঙ্গিদের গ্রেপ্তারে কাজ করছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে র‌্যাবের গোয়েন্দা টিম এ নিয়ে কাজ করছে। গত সোমবার গ্রেপ্তার হওয়া মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদ ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র অন্যতম শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান। ডাকাতির এক মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকাকালে জঙ্গিদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় এবং কারাগারে জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়।

 

জেল থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। ২০১৭ সালে জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিবের সঙ্গে পরিচয় সূত্রে জামাতুল আনসারে যোগদান করে।

 

মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত ২৩ আগস্ট কুমিল্লা সদর এলাকা থেকে আট তরুণ নিখোঁজ হয়। ২৫ আগস্ট নিখোঁজদের পরিবার কুমিল্লার কোতোয়ালি থানায় সাধারণ ডায়েরি করে।

 

আট তরুণের মধ্যে পালিয়ে আসা নিলয়কে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদ করে গোয়েন্দারা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পায় এবং নিলয়কে ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশন সেলের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

 

নিলয়ের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করে গত ৫ অক্টোবর কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া রিফাতসহ নতুন জঙ্গি সংগঠনের সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের জিজ্ঞাসাবাদে দেশে একটি নতুন জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়, যার নাম ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’।

 

কমান্ডার মঈন বলেন, র‌্যাব ফোর্সেস গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাবের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন গত সেপ্টেম্বর ২০২২ থেকে অদ্যাবধি বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ হওয়া আট তরুণের মধ্যে চারজনসহ নতুন জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র ৩৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সক্রিয় সদস্য এবং ২০২১ সাল থেকে এই জঙ্গি সংগঠনকে সহায়তা প্রদান এবং সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অপরাধে পাহাড়ি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফের ১৪ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় আনা হয়েছে।

 

বিভিন্ন পর্যায়ে গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা জানতে পারে, জামাতুল আনসারের আমির মো. আনিসুর রহমান ওরফে মাহমুদ নামের এক ব্যক্তি। যার নেতৃত্বে উগ্রবাদী সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। এ ছাড়াও উগ্রবাদী এই সংগঠনে ছয়জন শূরা সদস্য রয়েছে, যারা দাওয়াতি, সামরিক, অর্থ, মিডিয়া ও উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।

 

শূরা সদস্য আবদুল্লাহ মাইমুন দাওয়াতি শাখার প্রধান, গ্রেপ্তার মাসুকুর রহমান রনবীর সামরিক শাখার প্রধান, ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার মারুফ আহমেদ সামরিক শাখার দ্বিতীয় ব্যক্তি, মোশারফ হোসেন ওরফে রাকিব অর্থ ও গণমাধ্যম শাখার প্রধান, শামীম মাহফুজ প্রধান উপদেষ্টা ও প্রশিক্ষণের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং ভোলার শায়েখ আলেম বিভাগের প্রধান হিসেবে সংগঠনটিতে দায়িত্ব পালন করছে।

 

এই নতুন জঙ্গি সংগঠনের ৫৫ সদস্যকে পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের প্রধান নাথান বম, সামরিক কমান্ডার কথিত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ভাংচুং লিয়ান বম এবং অপর আরেক নেতা মিডিয়া শাখা প্রধান কথিত লে. কর্নেল লালজং মুই ওরফে মাওয়াইয়া এবং কথিত লে. কর্নেল লাল মুন ঠিয়াল ওরফে চির চির ময়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পার্বত্য চট্টগ্রামে আশ্রয় দিয়ে সামরিক প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।

 

এ তথ্যের পর বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তায় র‌্যাব নব্য জঙ্গি সংগঠনের পাহাড়ে প্রশিক্ষণরত জঙ্গি সদস্য এবং তাদের প্রশ্রয় প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান ও নজরদারি চলমান রেখেছে।

 

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, গত বছরের ২০ অক্টোবর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা এবং র‌্যাব-৭-এর বান্দরবান ও রাঙামাটি জেলার বিলাইছড়ি থানা এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে সমতল থেকে পাহাড়ে আত্মগোপনে থাকা সাত জঙ্গি এবং তাদের সহায়তাকারী তিনজন কেএনএফ সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর পর দিন ২১ অক্টোবর গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে বিলাইছড়ি থানায় সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা করা হয়।

 

গ্রেপ্তার সাত আসামির মধ্যে নব্য জঙ্গি সংগঠন ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’র সামরিক শাখার উপপ্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ মানিক ছিলেন।

 

গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য বিলাইছড়ি থানায় করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে পাঁচজন আসামির রিমান্ড আবেদন করেন। আদালত সংগঠনটির সামরিক শাখার উপপ্রধান সৈয়দ মারুফ আহমেদ ওরফে মানিকসহ পাঁচ আসামির ছয় দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।

 

সৈয়দ মারুফ আহমেদকে জিজ্ঞাসাবাদে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সম্ভাব্য অবস্থান সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যায়। প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় র‌্যাব গোয়েন্দা তথ্যের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-৭-এর এ ব্লক জঙ্গি সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদ এবং আইইডি বা বোমা বিশেষজ্ঞ মো. আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে গ্রেপ্তার করা হয়।

 

গ্রেপ্তার মাসুকুর রহমান রনবীর সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, তিনি ২০০৭ সালের পূর্বে পোস্ট অফিসে চাকরি করতেন। ডাকাতির এক মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে থাকাকালে জঙ্গিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং জেএমবির আদর্শে অনুপ্রাণিত হন। জেল থেকে বের হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন সময়ে কারাগারে থাকা জেএমবি সদস্য ও তাদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করেন। ২০১৭ সালে জামাতুল আনসারের শূরা সদস্য এবং অর্থ ও মিডিয়া শাখার প্রধান রাকিবের সঙ্গে পরিচয় হয়। তিনি প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য হিসেবে জামাতুল আনসারে যোগদান করেন।

 

২০২১ সালের নভেম্বর মাসে সিলেট থেকে চার তরুণের নিখোঁজের ঘটনায় তিনি জড়িত ছিলেন। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ শেষে নিখোঁজ ওই চার তরুণকে সে সামরিক শাখায় নিযুক্ত করে। প্রায় এক বছর পূর্বে সে সংগঠনের সামরিক শাখা প্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার সামরিক কার্যক্রমের দুটি শাখা ছিল, যার একটি পাহাড়ে এবং অপরটি সমতলে। সমতলে সামরিক শাখার কার্যক্রম তার নেতৃত্বে পরিচালিত হতো।

 

পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আত্মগোপন করেন এবং কিছুদিন আগে আত্মগোপনের উদ্দেশে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন।

 

গ্রেপ্তার আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলম হাটহাজারীর একটি মাদরাসা থেকে পড়াশোনা শেষে মাদরাসায় শিক্ষকতা করতেন। তার সাংগঠনিক নাম আলম। নিখোঁজ ৫৫ জনের তালিকায় আবুল বাশারের নাম রয়েছে। তিনি দীর্ঘদিন নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হুজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

 

হুজি সংগঠনে থাকাকালীন সময়ে ঝালকাঠির নলসিটি এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী কার্যক্রমের জন্য দায়ের করা নাশকতার মামলায় ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করেন। ২০১৬-১৭ সালের দিকে জামাতুল আনসারের আমির মাহমুদের মাধ্যমে জামাতুল আনসারে যোগ দেন।

 

পাহাড়ে প্রশিক্ষণের জন্য ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে গৃহত্যাগ করেন এবং ২ মাস সমতলের বিভিন্ন জায়গায় প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। পরে তিনি রনবীর ও রাকিবের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ গ্রহণের জন্য পার্বত্য অঞ্চলে যান।

 

বয়সে বড় হওয়ার কারণে পাহাড়ে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতিনির্ধারণী বৈঠকে যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পাহাড়ে র‌্যাবের অভিযান শুরু হলে তিনি ৫৫ জনের দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পাহাড় থকে পালিয়ে সিলেটে যান। তিনি সামরিক শাখার প্রধান রনবীরের সঙ্গে সিলেট, কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। কিছুদিন আগে তিনি রনবীরের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পসংলগ্ন এলাকায় আত্মগোপন করেন।

 

পাহাড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন কেএনএফের প্রধান নাথান বম কোথায় জানতে চাইলে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, রনবীর জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে, গত সেপ্টেম্বরের পর থেকে নাথান বমের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই। জামাতুল আনসারের আমিরের সন্ধান ও আইনের আওতায় আনা সম্ভব হলে নাথান বম সম্পর্কে জানা যাবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা