শাহীন রহমান: ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ স্থগিত করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। পরিকল্পনা কমিশনে ইসির এ প্রকল্প অনুমোদন না দেয়ায় ৫ মাসের মাথায় এসে সিদ্ধান্ত নিল ইসি। গত বছর ২৩ আগস্ট জাতীয় সংসদের ১৫০ আসনের ইভিএমে ভোটগ্রহণের আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এজন্য নতুন ইভিএম কিনতে একটি প্রকল্প প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনের পাঠায় তারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আগামী জাতীয় নির্বাচনের ১৫০ আসনে ভোটগ্রহণ করা হচ্ছে না। তবে ইসির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তাদের হাতে থাকা ইভিএম ব্যবহার করে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৬০ আসনে ভোট গ্রহণ করা হবে।
গত ৫ মাসে দেশের রাজনৈতিক মহলে ইভিএমে ভোটগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোনা হয়েছে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো এর প্রবল বিরোধিতা করে আসছে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বিরোধিতা সত্তে¡ও ইসি এককভাবে তাদের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। সবসময় ইভিএমের পক্ষে সাফাই গেয়ে আসছে। রাজনৈতিক দলগুলোকে রাজি করাতে ইভিএমে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়া দেখাতে ইসিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়।
তারপরও অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিপক্ষে মত দেয়। কিন্তু ইসি এ মত উপক্ষো করে ২ লাখ ইভিএমে মেশিন কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকার প্রকল্প পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায়। শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশন ইভিএমে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়নি। রোববার পরিকল্পন কমিশন এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় ইসিকে। সেখানে উল্লেখ করা হয়, নির্বাচন কমিশন চিঠি দিয়ে জানানো হয়েছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে সরকারের আর্থিক সামর্থ্য বিবেচনায় আপাতত প্রক্রিয়াকরণ হচ্ছে না।
সোমবার পরিকল্পনা কমিশনে ইভিএমে প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ার বিষয়টি আনুষ্ঠাকভাবে সাংবাদিকদের জানায় ইসি। সচিব মো. জাহাঙ্গীর আলম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আমরা পরিকল্পনা কমিশন থেকে সিদ্ধান্ত পেয়েছি। এ মুহূর্তে প্রকল্পটি তারা প্রক্রিয়াজাতকরণ করছে না। বাতিল হচ্ছে না, তবে এ মুহূর্তে হচ্ছে না। বৈশ্বিক পরিস্থিতি আর আর্থিক সংকটের বিবেচনায় ২ লাখ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কেনার নতুন প্রকল্প আপাতত স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত দিয়েছে সরকার।
গত বছর ২৩ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ওইদিন ইসির এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভা শেষে কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান। ইসির সিদ্ধান্তের আগেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। সেখানে অনেকেই এর বিরোধিতা করেন। আবার কেউ কেউ এর পক্ষে কথা বলেন।
পরে ইসির পক্ষ থেকে বলা হয় ইভিএমের ব্যবহারের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর আপত্তি এবং সমর্থন দুটিই রয়েছে। এর আগেই এ-সংক্রান্ত একটি সারসংক্ষেপ নিবন্ধিত ২৮টি রাজনৈতিক দল, আইন, স্বরাষ্ট্র, জনপ্রশাসন, অর্থ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তা ও সংশ্লিষ্টদের কাছে পাঠায় ইসি। ইসির ওই প্রতিবেদনে ইভিএম বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে পাওয়া মতামত ও পরামর্শের জবাবে তারা জানায় রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইভিএম নিয়ে সংলাপ, কর্মশালা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে।
কমিশন যেহেতু ইভিএমের সার্বিক বিষয়ে এখনো স্থির কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেনি, সেহেতু সদ্যসমাপ্ত রাজনৈতিক সংলাপ ছাড়াও ইতোপূর্বে ইভিএম নিয়ে আরো যেসব কর্মশালা, মতবিনিময়, পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে তার সার্বিক ফল পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বিচার-বিশ্লেষণ করে আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বিষয়ে কমিশন যথাসময়ে অবহিত করবে। বর্তমানে ইসির হাতে যেসব ইভিএম আছে, তাতে ৫০-৬০টি আসনে ভোটগ্রহণ সম্ভব।
৩০০টি সংসদীয় আসনের মধ্যে ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নেয়া নির্বাচন কমিশনের পক্ষে কঠিন। তারা বিচার-বিশ্লেষণ করে দেখেছে, যদি নতুন মেশিন কেনা না হয়, তাহলে ১০০ আসনে ভোট করাই সমস্যা সংকুল হয়ে যায়। ১৫০ আসনে ইভিএমে ভোট নিতে হলে কমিশনকে নতুন মেশিন কিনতে হবে। ইসির এ সিদ্ধান্তের পরই নতুন করে ইভিএম কিনতে ৮ হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব তৈরি করে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয় গত ১৯ অক্টোবর। প্রকল্পটির নাম দেয়া হয়, নির্বাচনী ব্যবস্থায় ইভিএম ব্যবহার বৃদ্ধি এবং টেকসই ব্যবস্থাপনা। প্রথমে কারিগরি কমিটির মতামত ছাড়াই প্রকল্পটি পাঠানো হয়েছিল।
যে কারণে পরিকল্পনা কমিশন ওই কমিটির মতামতসহ কিছু ‘পর্যবেক্ষণ’ দিয়ে গত নভেম্বরের প্রকল্পটি ইসিতে ফেরত পাঠায়। পরে বড় ধরনের কাটছাঁট ছাড়াই এক সপ্তাহের মধ্যেই ইভিএম প্রকল্প পাশের জন্য পরিকল্পনা কমিশনে পাঠায় ইসি। এক সভায় কারিগরি কমিটির সুপারিশসহ স্বাক্ষর নিয়ে প্রকল্প প্রস্তাবটি পুনরায় চূড়ান্ত করা হয়। এরপর তা পাসের জন্য পরিকল্পনা কমিশনের পাঠানো হয়।
অথচ প্রকল্পটি ইসিতে ফেরত পাঠানোর সময় পরিকল্পনা কমিশন কিছু ক্ষেত্রে ব্যয় কমানোসহ ফিজিবিলিটি স্টাডির কথা উল্লেখ করেছিল। এর জবাবে ইসি জানায়, যেহেতু তারা আগে থেকেই ইভিএম ব্যবহার করছে, তাই একই যন্ত্রের ওপর ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রয়োজন নেই। এক্ষেত্রে টেকনিক্যাল কমিটির সুপারিশ নিয়েই প্রস্তাবটি ফের পাঠানো হয় পরিকল্পনা কমিশনে অনুমোদনের জন্য।
ইসির অনুমোদিত প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪৫ হাজার ভোটকেন্দ্র থাকবে। এর মধ্যে ইভিএমে ভোট হবে এরকম ১৫০ আসনে, কেন্দ্র থাকবে ২৫ হাজার। প্রতি কেন্দ্রে ৭টি করে ইভিএম থাকবে। প্রতিটি কক্ষে গড়ে দেড়টি করে মোট ২ লাখ ৬২ হাজার ৫০০ কোটি ইভিএম সেটের প্রয়োজন হবে। এর বাইরে ভোটারদের শিখনের জন্য প্রতি কেন্দ্রে দুটি করে ৫০ হাজার এবং প্রশিক্ষণে ব্যবহারের জন্য আরো ২৫ হাজার প্রয়োজন হবে। এছাড়া রিজার্ভ হিসেবে আরো ৫০০ ইভিএমের প্রস্তাব করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে মোট ৩ লাখ ৩৮ হাজার ইভিএমের প্রয়োজনীয়তার কথা জানিয়েছে ইসি। এসব সেট সংরক্ষণেও বিশাল খরচ গুনতে হবে। ১০টি অঞ্চলে স্টিল কাঠামোর ওয়্যারহাউস নির্মাণ করা হবে। এতদিন ইভিএম সেট সংরক্ষণে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি বকেয়া বাবদ ৩৬ কোটি ২১ লাখ টাকা দাবি করেছে তারা। ইসির প্রস্তাবে ১৫০ আসনে ভোটের জন্য ৩ লাখ ৩৮ হাজার ইভিএম সেট কেনার প্রস্তাব করা হয়।
এর মধ্যে ১ লাখ ৩৮ হাজার সেট ইসির হাতে রয়েছে উল্লেখ করা হয়। নতুন কিনতে হবে ২ লাখ ইভিএম সেট। প্রতিটি সেটের দাম ধরা হয় ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। কমিশনের হাতে থাকা বর্তমানের প্রতিটি ইভিএম সেট কেনা হয় ২ লাখ ৫ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতিটি মেশিনে ১ লাখ টাকা করে বেশি দাম ধরা হয়। প্রস্তাবে ৪টি জিপগাড়ি এবং ৫৩৪টি ডাবল কেবিন পিকআপ কেনার কথাও বলা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পরিকল্পনা কমিশন সরকারের আর্থিক সমস্যার কথাটি বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্পটি প্রক্রিয়াকরণ করেনি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ইসি সচিব জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ইসির হাতে এ মুহূর্তে যে ইভিএম আছে, তা দিয়ে ৫০-৬০টি আসনে ইভিএমে ভোটগ্রহণের প্রস্তুতি চলবে। ২০১৮ সালের ইভিএম দিয়ে যা সম্ভব, তা ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত রয়েছে, তা বহাল রয়েছে। সেক্ষেত্রে ৫০-৬০ আসনে ইভিএমে ভোট হতে পারে।
ভোরের আকাশ/নি