বাংলাদেশের মূল চালিকাশক্তি বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ। আমরা বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ না দিলে মুক্তিযুদ্ধ হতো না। আর মুক্তিযুদ্ধ না হলে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা বিশ্বময় পতপত করে উড়ত না। বঙ্গবন্ধুর আশা-আকাক্সক্ষা, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি উপলব্ধি করেছেন, বঙ্গবন্ধু বাঙালির অধিকার, বিশ্বের দরবারে বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে- এসব দেখতে চান। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান হিসেবে এ উপলব্ধি তার চোখ এড়ায়নি।
বঙ্গবন্ধু জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারে কাটিয়ে শুধু বাঙালিকে বিশ্বদরবারে সগৌরবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, কিছু কুচক্রী নরাধম কাপুরুষ তাকে সপরিবারে হত্যা করে। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় হলো, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই কুচক্রীরা ক্ষান্ত হয়নি; হত্যার বিচার করা যাবে না- এ মর্মে আইনও পাস করিয়েছিল। কতটা অসভ্য চিন্তার অধিকারী হলে, কতটা অগণতান্ত্রিক চেতনা ধারণ করলে এ অসভ্য, অভব্য আচরণ করা যায়! এমনকি বঙ্গবন্ধুর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে অবস্থান করায় তাদের দেশে ফিরে আসার ব্যাপারেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছিল!
এ কথা আমরা জানি, মিথ্যা দিয়ে সত্য ঢাকা যায় না; বরং সত্য সবসময় ফুলের মতো প্রস্ফুটিত হয়। কেউ কি ভেবেছিল- বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার ধমনিতে প্রবাহিত, যিনি স্বামী-সংসার, পুত্র-কন্যা নিয়ে জীবনযাপন করছিলেন, তিনি বাংলাদেশকে রোলমডেল হিসেবে বিশ্বের বুকে তুলে ধরবেন? কেউ না ভাবলেও বিষয়টি নির্মোহ সত্য। ভুলে গেলে চলবে না, শেখ হাসিনা এক রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান। ছাত্রজীবনে তিনি ছাত্রলীগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন। ইডেন কলেজের ছাত্রী সংসদের সহসভাপতি ছিলেন। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে তিনি ও শেখ রেহানা আসেন সব হারিয়ে অনাথিনীর বেশে। নিজ বাড়িতে ঢুকতেও পারেননি। সব হারিয়ে শেখ হাসিনার শোকে পাথর হওয়ার কথা। কিন্তু না, তিনি পাথর হননি। সব বেদনা হৃদয়ে ধারণ করে তিনি জনতার ইচ্ছা অনুযায়ী আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি হন।
এরপর অনেক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের বেড়াজাল ভেঙে তিনি স্বমহিমায় বাঙালির মনের মণিকোঠায় অবস্থান করতে থাকেন। বহু চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সরকারের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের জনগণ ষড়যন্ত্র দেখেছে, সামরিক শাসন দেখেছে, অগণতান্ত্রিক, অমানবিক অনেক কিছু দেখেছে; কিন্তু সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকে প্রথম দেখার সুযোগ পেল। বড় বড় রাজনৈতিক দলে কিছু অন্তর্দ্বন্দ্ব থাকে, কিছু উপদল থাকে। শেখ হাসিনাকেও এসব দেখতে হয়েছে। কিন্তু চিন্তা-চেতনায় তিনি বঙ্গবন্ধুর মতো অবিচল। তিনি ছাত্রলীগ করেছেন, বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ দেখেছেন, এরপর তিনি সংস্কারপন্থিও দেখেছেন। নিজ হাতে সব সামলে নিয়েছেন। কারণ তিনি বিশ্বাস করেন, ‘ভালো কাজ, মানবতা ও ভালোবাসা’ তাকে মানুষের মনের মণিকোঠায় বসিয়ে রাখবে। লক্ষ্যে যিনি স্থির, নিজের কোনো চাওয়া-পাওয়া যার নেই, তিনি তো মানুষের হৃদয়েই অবস্থান করবেন।
যার কামনা-বাসনা- ‘এদেশে কেউ ভূমিহীন, গৃহহীন থাকবে না’; তাকে এগিয়ে যেতে কে রুখতে পারে? এখানে ২০ বছর পর ফেরা এক বাঙালি অধ্যাপকের কথা উল্লেখ করতেই হয়, ‘বিমানবন্দরে নেমে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, আমি কি ঢাকায় পৌঁছলাম? তিনি বিস্মিত হয়েছেন, বিস্ফারিত চোখ মেলে বললেন, এ-ও কি সম্ভব?’ বিমানবন্দরের লাগেজ ট্যাগ খুলতে খুলতে বিমানকর্মী বললেন, ‘স্যার, এটা আমাদের প্রধানমন্ত্রী করেছেন, তিনি বিশ্বব্যাংক ও বড় মোড়লদের ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিয়ে পদ্মা সেতু করেছেন নিজেদের টাকায়।’ পদ্মা সেতু নিয়ে অনেক কাহিনী হয়েছে, অনেক গল্প হয়েছে। বাংলাদেশকে বদনামের ভাগি হতে হয়েছে। কিন্তু পাহাড়ের মতো অটল শেখ হাসিনা সংসদে বলেছেন, ‘বিশ্বব্যাংককে বলতে হবে- কত টাকার দুর্নীতি হয়েছে’? বিশে^র বড় মোড়লরা নিশ্চুপ। বিশ্বব্যাংক এক টাকাও ছাড় করেনি, তাহলে দুর্নীতি হলো কোথায়?
সবচেয়ে দেখার মতো বিষয় হলো, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। আমার খুব মনে পড়ছে কবি সুকান্তের কথা, ‘শাবাশ বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়। জ্বলে-পুড়ে মরে ছারখার, তবুও মাথা নোয়াবার নয়।’ কবি সুকান্ত বাঙালি ও বাংলাদেশকে বুঝে কবিতা লিখেছিলেন আর শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে রোলমডেলের দেশ তৈরি করেছেন। টেমস নদীর তলদেশে আমরা রাস্তা দেখেছি, হেঁটেছি; কিন্তু কর্ণফুলী নদীর নিচে কি টানেল দেখার কথা কখনো ভেবেছি? মাথার ওপর দিয়ে রেল চলবে, ফুটবল খেলার মতো চওড়া রাস্তা হবে- আমরা কি ভেবেছি?
আজ আর বাংলাদেশ হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, আজ বাংলাদেশ রোলমডেলের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এখন অনেক এগিয়ে, অনেক ইনডেস্কে পাকিস্তান ও ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। তাই আমরা বলতে পারিÑ শেখ হাসিনা করতে পারেন, করে দেখিয়েছেন, আগামীতে আরো করবেন।
জয়তু শেখ হাসিনা
ভোরের আকাশ/আসা