দুবাই থেকেই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে বাংলাদেশের অপরাধজগৎ। দেশের আলোচিত সন্ত্রাসীরা সেখানে বসেই শিষ্যদের দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী মিশন বাস্তবায়ন করছে এদেশীয় উঠতি সন্ত্রাসীরা। প্রতিপক্ষকে সাইজ করতে দুবাই গিয়ে আলোচিত সন্ত্রাসীদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন অনেক ব্যবসায়ী বা রাজনৈতিক নেতা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে খুনের চুক্তি ও পরিকল্পনা হচ্ছে দুবাই বসে। এছাড়া দেশের ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে আয়ের একটি অংশ হুন্ডির মাধ্যমে দুবাইয়ে অবস্থানরত সন্ত্রাসীদের কাছে চলে যাচ্ছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব সন্ত্রাসীর পেছনে নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন। তারা পেছন থেকে তাদের শক্তি জোগান। এ শক্তি জোগানো যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন অপরাধ দমন সম্ভব নয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ, প্রকাশ, তানভীর, শাহাদাত, জোসেফ ও জিসানসহ বেশ কয়েকজন। এদের মধ্যে দুবাই অবস্থান করছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। জিসানের সঙ্গেই যোগাযোগ রয়েছে সব সন্ত্রাসীর। বাংলাদেশ থেকে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির টাকা যাচ্ছে জিসানের কাছে। এরপর সেই টাকা জিসান বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত সন্ত্রাসীদের মাঝে বণ্টন করে দিচ্ছেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দেশ থেকে এসে দুবাইয়ে জিসানের মেহমান হচ্ছে আলোচিত সন্ত্রাসীরা।
দুবাইয়ে অবস্থানরত কয়েকজন বাংলাদেশি ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের আন্ডারওয়ার্ল্ডের শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল দুবাই। এখানে বসেই বিভিন্ন দেশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন তারা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ থেকে আসা চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজির টাকায় এখানে রাজকীয় জীবনযাপন করেন বাংলাদেশের সন্ত্রাসীরা। এছাড়া দেশের অনেক শিল্পপতি এখানে এসে তাদের উপঢৌকন দিয়ে যান। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে তাদের সহায়তা নেন অনেক ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক নেতা।
সূত্র মতে, সর্বশেষ মতিঝিল আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনা হয় দুবাইয়ে। শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী মুসাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় টিপু হত্যাকাণ্ডের। হত্যাকাণ্ডের ১২ দিন আগে শুটার গ্রুপকে দায়িত্ব দিয়ে দুবাই চলে যান মুসা। তবে দুবাই থেকে ওমান গিয়ে ইন্টারপোলের হাতে ধরা পড়েন তিনি। পরে গোয়েন্দা পুলিশ ওমান থেকে মুসাকে দেশে ফিরিয়ে আনে।
রিমান্ডে গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে মুসা জানান, মতিঝিল এলাকায় টিপুর একক আধিপত্য বিস্তারকে আগামী দিনের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেকের পথের কাঁটা হতে পারেন বলে মনে করেন। স্বেচ্ছাসেবক লীগ কানাডা শাখার সাধারণ সম্পাদক সোহেল শাহরিয়ার মতিঝিল এলাকায় নির্বাচনে অংশ নিতে চান। এর আগে মতিঝিলে ক্যাসিনোর চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রক গ্রুপের তোপের মুখে সোহেল ২০১৬ সালে কানাডায় পাড়ি জমান। সেখানে তিনি স্বেচ্ছাসেবক লীগ কানাডা শাখার সাধারণ সম্পাদক পদ পান। ২০১৯ সালে ক্যাসিনোয় অভিযান চালানোর পর সোহেল দেশে ফেরেন। মতিঝিল এলাকার রাজনৈতিক ও আন্ডারওয়ার্ল্ডে একক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করেন। মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সভাপতির পদ তিনি প্রত্যাশা করেন। এ নিয়ে টিপুর সঙ্গে সোহেলের দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। সম্প্রতি সোহেল দেশে ফিরে মতিঝিলের ঘর গোছানো শুরু করেন। সোহেলের সঙ্গে দুবাইয়ে আত্মগোপন করা শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের যোগাযোগ হতো।
অন্যদিকে ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেপ্তার যুবলীগের ল্যাংড়া খালেদও তার হারানো সাম্রাজ্য ফিরে পেতে হাত মেলান জিসানের সঙ্গে। টিপু হত্যায় আন্ডারওয়ার্ল্ডে ২ কোটি টাকার লেনদেন করা হওয়ার কথা ছিল। কিলিং মিশনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য ১৫ লাখ টাকা পাঠানোর নির্দেশ দেন সোহেল। এই ১৫ লাখ টাকার মধ্যে ৯ লাখ টাকা আগাম টাকা হিসেবে দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হয় কিলার গ্রুপের সদস্য আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহের কাছে। শুটার সালেহ অবশ্য মুসার আপন ছোট ভাই। হন্ডিতে পাঠানো ৯ লাখ টাকা কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া ১২ জনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, দেশে অবস্থান নিরাপদ নয় বলে সন্ত্রাসীরা বিদেশে অবস্থান করছেন। সেখানে বসে তারা তাদের সহযোগী শক্তির মাধ্যমে দেশে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অপরাধ করছেন। এ সহযোগী শক্তিকে আগে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তাহলে অনেকটা অপরাধ কমে আসবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তুলে এ অপরাধ বিশ্লেষক বলেন, যাদের নামে মামলা আছে, তারা তো দেশের বাইরে যাওয়ারই কথা নয়। কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ম্যানেজ করে দেশ ছাড়েন। পরে বিদেশে অবস্থান করে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন।
তিনি বলেন, এসব সন্ত্রাসীর পেছনে নানা ধরনের পৃষ্ঠপোষক রয়েছেন। তারা পেছন থেকে তাদের শক্তি জোগান। এ শক্তি জোগানো যতদিন বন্ধ না হবে, ততদিন অপরাধ দমন সম্ভব নয়। অদৃশ্য শক্তির অপরাধীদের আরো উসকে দিচ্ছে। পেছনের কারিগরকে গ্রেপ্তার করা না গেলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। তৌহিদুল হক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ভূমিকা যতটা জোরালো হওয়ার কথা, তা দেখি না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আরো মনোযোগী না হলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। শীর্ষ সন্ত্রাসীর সংখ্যা কমানো যাবে না।