logo
আপডেট : ২৩ মে, ২০২২ ১০:৪৬
পুণ্যের আশায় পাহাড়ের পথে পথে ‘চেহ রাই’ ঘর
রিজভী রাহাত, বান্দরবান

পুণ্যের আশায় পাহাড়ের পথে পথে ‘চেহ রাই’ ঘর

চেহ রাই ঘরে মাটির কলসে রাখা পানি পান করে তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন পথচারীরা

পথিকের ক্লান্তি দূর করতে পথের পাশে সরাইখানা তৈরি ও পানি পানের ব্যবস্থার এক উজ্জ্বল নিদর্শনের দেখা মিলবে বান্দরবানের পাহাড়ি পথে। মারমা জনগোষ্ঠী লোকদের তৈরি এসব বিশ্রামাগার বা ‘চেহ রাই’ ঘর দুর্গম ও দূরের পথিকের ক্লান্তি এবং তৃষ্ণা দূর করে থাকে। মূলত মনের তাগিদে এবং পুণ্যের আশায় মারমা জনগোষ্ঠী বহুদিন আগে থেকে এই কাজ করে আসছে।

মারমা ভাষায় ‘চেহ রাই’ শব্দের অর্থ ‘বিশ্রাম নিবাস’। এতে পথিকের বিশ্রামের জন্য বড় গাছের নিচে বাঁশ-কাঠের মাচাং (ছাউনি) তৈরি করে বসার ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া তৃষ্ণা নিবারণে সেখানে মাটির কলসে পানি ও মগ রাখা থাকে। পাহাড়ি পথ এলাকায় টিউবওয়েল বা রাস্তার পাশে চায়ের দোকান তেমন নেই। তাই ‘চেহ রাই’ বড় ভরসা। মারমা জনগোষ্ঠীর মধ্যে এ ধরনের সংস্কৃতি বহুকাল থেকে প্রচলিত।

সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, বান্দরবান-চন্দ্রঘোনা সড়কে জেলা শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরে ক্যামলংপাড়ায় বিশাল বটগাছের নিচে একটি ‘চেহ রাই’। এ ছাড়া সড়কের জয়মোহনপাড়া, জামছড়িমুখপাড়া, থোয়াংইঙ্গ্যাপাড়াসহ প্রত্যন্ত এলাকায় এই ঘর দেখা যায়।

বান্দরবান সদর ইউনিয়নের জয় মোহন পাড়া, জামছড়ি ইউনিয়নের জামছড়িমুখ পাড়া, কুহালং ইউনিয়নের থোয়াইঙ্গ্যা পাড়া, ক্যামলং পাড়াসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো ক্ষণিকের আশ্রয়কেন্দ্র এই মানবতার ঘর দৃশ্যমান।

একইভাবে বান্দরবান-চিম্বুক সড়কের নয়মাইল (নয়াপাড়া) এলাকায়, বান্দরবান-থানচি ও বান্দরবান-রুমা সড়কের কয়েকটি স্থানে এই ঘর দেখা গেছে।

ক্যামলংপাড়ার বাসিন্দা খেই সাং উ মারমা (৬০) বলেন, ‘এটি মারমা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ।’

বান্দরবানের বাসিন্দা সংবাদকর্মী আকাশ মারমা মংসিং বলেন, ‘চেহ রাইগুলো পথিকের বিশ্রাম ও তৃষ্ণা নিবারণের জন্য হলেও এখানে স্থানীয় পঞ্চায়েত সালিশ, আড্ডা বসে। রাতে পাড়া পাহারার জন্য এটি ব্যবহার হয়। পাহাড়িদের সংস্কৃতির অংশ এই ঘর। তবে কখন থেকে এটা চালু হয়েছে নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারেন না।’

তিনি আরো বলেন, ‘কাজটি ছোট বলে মনে হলেও, দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় এ ধরনের ব্যবস্থায় অনেকেই উপকৃত হয়। পাহাড়ি এলাকায় রাস্তার পাশে বসার তেমন ব্যবস্থা থাকে না। দোকানপাট, হোটেলও থাকে না। তাই পথিক ও আশপাশের শ্রমজীবীদের ভরসাস্থল চেহ রাই।’

চেহ রাই ঘরে মাটির কলসে রাখা পানি পান করে তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন পথচারীরা

ক্যামলংপাড়ার বাসিন্দা মংছো মারমা (৬৫) জানান, আদিকাল থেকে বিশ্রামের জন্য চেহ রাই ঘর সংস্কৃতির প্রচলন। তাদের পূর্ব পুরুষরা চেহ রাই ঘরটি নালিশ, সালিশ, আড্ডা এবং রাতে পাড়া পাহারার জন্য ব্যবহার করেন।

জামছড়ি পাড়াবাসী মিথুই চিং মারমা নামে এক নারী বলেন, সাধারণ মানুষ বিশ্রামের পর যাতে পানি পান করতে পারেন সে ব্যবস্থা করা আছে চেহ রাই ঘরে।

সদর উপজেলার কুহালং ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান সানু প্রু মারমা (৭৫) বলেন, ‘চেহ রাই তৈরি করে পথিকদের সাময়িক বিশ্রাম ও তৃষ্ণা মেটানোর কাজ করা হয়। এটি একটি পুণ্যের কাজও বটে। কবে এটি চালু হয়েছে নির্দিষ্ট করে বলা না গেলেও শতাধিক বছর আগে থেকে এর প্রচলন রয়েছে বলে ধারণা করা যায়।’

চেহ রাই ঘরে মাটির কলসে রাখা পানি পান করে তৃষ্ণা মিটাচ্ছেন পথচারীরা

 

সদর উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান ও হ্নারা মৌজা হেডম্যান রাজু মং মারমা বলেন, ‘বান্দরবানের সাতটি উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনো চেহ রাই প্রচলিত রয়েছে। পুণ্যের আশায় পাহাড়ি লোকজন এ ধরনের ব্যবস্থা করেন।’

বান্দরবান ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সাংস্কৃতিক ইনস্টিটিউট (কেএসআই) পরিচালক মংনুচিং জানান, ‘চেহ রাই মূলত মারমাদের ঐতিহ্য-সংস্কৃতি। সংস্কৃতির অনেক কিছু বিলুপ্ত হলেও অল্প কাজ এখনো প্রচলিত রয়েছে। তবে কখন থেকে এর প্রচলন, তা সঠিকভাবে বলা যাচ্ছে না।’