logo
আপডেট : ১৭ মে, ২০২২ ১১:৩৬
বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস আজ
গ্রাহক বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি
# মানের দিক থেকে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৮তম স্থানে
ইফ্ফাত শরীফ

গ্রাহক বাড়লেও সেবার মান বাড়েনি

মাগুরার মোহাম্মদপুর উপজেলার কানাই নগর গ্রামের বাসিন্দা ফরিদা বেগম। ঢাকায় সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে প্রতিদিনই এক দুইবার ফোন করতে হয়। তবে নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ঘরের ভেতর থেকে কথা বলতে পারেন না। এজন্য তাকে প্রায়ই উঠানে বা পুকুর পাড়ে যেতে হয়। ঘরের মধ্যে ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। এ কারণে কল দিলে কেটে যায়। স্পষ্ট কথাও শোনা যায় না। শেখ মোখতার হোসেন থাকেন গোপালগঞ্জের গোলাবাড়িয়া গ্রামে। তারও একই সমস্যা। গ্রামে মোবাইলে এই নেটওয়ার্ক সমস্যা শুধু ফরিদা বা আখতারের নয়। সবার এখন এই অভিযোগ। নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না প্রিয়জনের সঙ্গে।

দেশে টেলিকমিউনিকেশন সেবায় গ্রাহকদের নিত্য অভিযোগ যখন-তখন কল ড্রপ, ইন্টারনেটের দুর্বল গতি, ভয়েস কলের নিকৃষ্ট মান ও দেরিতে কল সংযোগ নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরেই এ ধরনের অভিযোগ চলে আসছে। প্রতিনিয়ত ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীদেরও। কিন্তু কোনো প্রতিকার নেই। নেটওয়ার্কের এই দুর্বল ব্যবস্থাপনা নিয়েই দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস। দিবসটি পালনে মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়া হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনার পর গ্রাহক বাড়লেও অপারেটরগুলোর সেবার মান সেভাবে বাড়েনি। সেবার মান অন্যান্য দেশের থেকেও অনেক খারাপ। বৈশ্বিক নানা সূচকেও বাংলাদেশের মোবাইল ইন্টারনেট গতির দিক থেকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরের ওকলা স্পিডটেস্ট গ্লোবাল ইনডেক্সে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ১২৮তম স্থান লাভ করে।

যদিও মোবাইল অপারেটরগুলো করোনাকালীন তাদের সেবার মান বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছিল। কিন্তু এ সময়ে সেবার মান বাড়াতে পারেনি। ২০১৯ সালে দেশে মোট মোবাইল ফোন গ্রাহকের সংখ্যা ছিল ১৬ কোটি ৫৫ লাখ। ২০২০ সালের মার্চে দেশে মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশে মোবাইল ফোন গ্রাহক বেড়েছে ১ কোটি ৫৯ লাখ। যা ২০২১ সালের নভেম্বরে ১৮ কোটি ১৫ লাখে ঠেকেছে। গ্রাহক বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ব্যাপকভাবে বেড়েছে মোবাইল অপারেটরগুলোর আয়ও। তবে কল ড্রপ, নেটওয়ার্ক সমস্যার মতো এ সকল সাধারণ সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

আর ব্রডব্রেন্ডের ক্ষেত্রে যে সমস্যা তা হচ্ছে অন্যান্য সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একধরনের সমন্বয়ের ঘাটতি। ব্রডব্রেন্ডে অনেক বেশি তারের সংযোগ থাকে। যার ফলে অন্য সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান তাদের কাজ করতে গিয়ে ফাইবার গুলো কেটে ফেলে। এ কারণে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়। একইভাবে গ্রাহক ও তার যথাযথ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

দেশের টেলিকমিউনিকেশন সেক্টর নিয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চেন্সেলর সত্য প্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে কথা হয় ভোরের আকাশের। তিনি বলেন, টেলিকমিউনিকেশন সেক্টরে একধরনের বিপ্লব হয়েছে। শহর থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদ পর্যন্ত ফাইবার চলে যাওয়া অনেক বড় একটা বিষয়। যেখানে বাংলাদেশের আগে ছিল একটা সাবমেরিন কেবল আর এখন চারটা সাবমেরিন কেবলের সঙ্গে যুক্ত আছে দেশ। আর স্যাটেলাইট যোগাযোগের মধ্যে বঙ্গবন্ধু সেটেলাইট-১ বিশাল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বিশেষ করে আমাদের সামরিক বেসামরিক খাতগুলোর জন্য আগে স্যাটেলাইট ভাড়া করতে হতো এখন আর তা করতে হচ্ছে না। এ ছাড়া আমাদের ‘ব্লু’ ইকোনমির নজরদারিতে স্যাটেলাইট অনেক ভূমিকা রাখবে।

তিনি বলেন, ভবিষ্যতে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ যে আসছে তার মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ খনিজগুলোর অনুসন্ধান করা যাবে। মাটির নিচে কোথায় গ্যাস, কোথায় তেল আছে তা অনুসন্ধান করা যাবে। যার ফলে সার্ভে করে বোঝা যাবে আমাদের কোথায় কী সম্পদ আছে।

টেলিযোগাযোগে আমরা যে সেবাটা পাচ্ছি তা কি আন্তর্জাতিকভাবে মানসম্মত কি না এ ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে ২.৫-জি থেকে এখন ৫-জিতে চলে এসেছি। কোনো দেশ এত অল্প সময়ে ৫-জি তে ঢোকেনি। আর এই ৫-জি কানেক্টিভিটি দিচ্ছে, কিন্তু ফাইবার বেকবোন। এই ফাইবার বেকবোন ছাড়া কিন্তু কেউ ৫-জি সেবা দিতে পারবে না। যতগুলো মোবাইল অপারেটর আছে প্রত্যেকেই কিন্তু বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল)-এর আন্ডারগ্রাউন্ড ফাইবার ব্যবহার করছে।’

ফাইভার, স্যাটেলাইট এবং সাবমেরিন কেব্্ল এই তিনটি হচ্ছে কমিউনিকেশনের অংশ। আর এই তিনটিই আমাদের দেশে স্থাপিত হয়েছে। যা বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবসে বাংলাদেশের জন্য একটা বড় প্রাপ্তি। প্রাপ্তির সঙ্গে কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে।

মোবাইল অপারেটরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের কলড্রপের যে সমস্যা এ ব্যাপারে বুয়েটের এই ভাইস চেন্সেলর বলেন, ‘একটা কল ড্রপ হয়ে যাচ্ছে আমি কেন আবার ডায়াল করব! এই ক্ষেত্রে গুণমান প্রত্যাশিত সার্ভিসটা কিন্তু বাংলাদেশ এখনো পাচ্ছে না। মোবাইল অপারেটরদের সেবার মান এখনো আন্তর্জাতিক মানের হয়নি। আমরা কিন্তু ব্যান্ডউইথ ঠিকই পাচ্ছি। তবে এই ব্যান্ডউইথকে যথাযথ ব্যবহার করতে হলে মানসম্পন্ন সেবার প্রয়োজন। বিদেশে একটা কল ড্রপ হলে সেই প্রতিষ্ঠানকে কিন্তু শাস্তি দেয়া হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এর কোনো ব্যবস্থা হয় না। তবে কেন এইটা হচ্ছে এ বিষয়টি উদ্ঘাটনে নজর দেয়া প্রয়োজন।’

বিশ্ব টেলিযোগাযোগ দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন এ প্রশ্নের জবাবে বুয়েটের ভিসি সত্য প্রকাশ মজুমদার বলেন, ‘টেলিকমিউনিকেশন গবেষণার দিকে বাংলাদেশকে আরো নজর দেয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রিসার্চ সেন্টার হওয়া উচিত। কারণ সামনে আমাদের আরো নতুন প্রযুক্তি আসবে। ৫-জির পরে ৬-জি আসবে এবং ফাইবার অপটিকের পরে ফোটনিক প্রযুক্তি আসবে। ফোটনিক হচ্ছে সবচেয়ে আধুনিক প্রযুক্তি। এসবের উপর গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালগুলোতে ফান্ডিং বাড়াতে হবে। ফটোনিক প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার মতো ল্যাব কিন্তু আমাদের দেশে নেই। এগুলো হলে আমরা আরো অনেক উন্নতি করব।’