logo
আপডেট : ২৯ এপ্রিল, ২০২২ ১২:৫৮
সাপপ্রেমিক মিজান
রাজশাহী ব্যুরো

সাপপ্রেমিক মিজান

দেশে প্রায় ৯০ প্রজাতির সাপ আছে। বিভিন্ন সময়ে সাপ মানুষের কাছাকাছি চলে আসে। আর সাপের নাম শুনলেই যেমন গা শিউরে ওঠে, তেমনি অনেকে লাঠি হাতে নেন মারার জন্য। এ ধরনের পরিস্থিতিতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ওই সাপ উদ্ধার করেন। যে সাপ প্রকৃতির যে ধরনের পরিবেশে থাকে, সেটিকে সেই পরিবেশে ছেড়ে দেন তিনি।

বলছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) শিক্ষার্থী মিজানুর রহমান মিজানের কথা। শুধু সাপ উদ্ধার নয় সাপকে রক্ষা করতে রাবির প্রত্যেকটি হলে তিনি সাপ বিষয়ক সচেতনামূলক পোস্টার সাঁটিয়েছেন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতেও সচেতনামূলক প্রচারণা চালাচ্ছেন।

রাবির ম্যানেজমেন্ট স্ট্যাডিজ বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মিজান। যুক্ত আছেন ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশন নামের সাপ ও পরিবেশ নিয়ে কাজ করা একটি সংগঠনের সঙ্গে। সংগঠনটির একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি তিনি। গ্রামের বাড়ি ঢাকার কেরানীগঞ্জ উপজেলার জিনজিরা ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে। বাবা মঞ্জুর হোসেন ও তাসলিমা বেগমের বড় ছেলে তিনি।

সাপ নিয়ে সবার মাঝে ডর-ভয় থাকলেও তার মাঝে নেই। হাতে থাকে নিজের বানানো স্নেক ক্যাচার (সাপ ধরার মেশিন)। মানুষের হাত থেকে বাঁচাতে অনায়াসেই যে কোনো বিষাক্ত সাপ উদ্ধার করছেন।

পরিবেশ রক্ষায় মিজানের এমন উদ্যোগে ক্যাম্পাসে সবাই তাকে এক নামে চেনে। কিন্তু কাজটা এতটা সহজ ছিল না তার। এই সাপ ধরার গল্প নিয়ে কথা হয় প্রকৃতি প্রেমিক মিজানের সঙ্গে।

এমন উদ্যোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মিজান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সাপের গুরুত্ব বিবেচনায় এমন উদ্যোগ নিয়েছি। প্রথমদিকে এই উদ্যোগকে মজার ছলে উড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু আমি হাল ছেড়ে দেয়নি। তবে এখন সবার কাছ থেকে উৎসাহ পাই। সাপ উদ্ধার করতে পারলে আমার মধ্যে ভালো লাগা কাজ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘ইক্যুলজিক্যাল ব্যালেন্স রাখতে সাপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই ইক্যুলজিক্যাল ব্যালেন্স মানুষের বেঁচে থাকতে খুব দরকার। সাপ খুবই নিরীহ একটা প্রাণী। পৃথিবীর মোট সাপের ৪ ভাগের ১ ভাগ বিষাক্ত হওয়া সত্ত্বেও মানুষ সাপ দেখলে ভয়ে পালায়। মেরে ফেলে। নিজের (সাপের) ক্ষতির আশঙ্কা না থাকলে কাউকে কামড়ায় না।

‘প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে মানুষকে সাপ না মারতে আহ্বান করতাম। কেউ সাড়া না দেওয়ায় নিজেই এদের উদ্ধার করে প্রকৃতির কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই।’

মিজান জীবনে প্রথম সাপ উদ্ধার করেন ২০১৯ সালের ১ অক্টোবরে। রাবির রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাডেমিক ভবনের ভেতরে জমে থাকা বৃষ্টির পানি থেকে।

সবুজের অভয়ারণ্য ৭৫০ একর আয়তনের রাবি ক্যাম্পাসে রয়েছে অনেকগুলো ডোবা, নালা, পুকুর, ঝোপঝাড়। হারহামেশাই এখানে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ চোখে পড়ে। কখনো ঝোপঝাড় বা কখনো লোকালয়ে বিভিন্ন প্রজাতির সাপ দেখা যায়। এসব সাপের মধ্যে রয়েছে- খৈয়া গোখড়া, ঘরগিন্নি, বেত আছড়া, হেলে, মেটে, জল ঢোড়াসহ নানা রকমের প্রজাতি।

সাপ যেখানেই বিপদে পড়ুক তাকে উদ্ধার করা যেন মিজানের দায়িত্ব। সেটা হোক ক্যাম্পাস, নিজ এলাকা অথবা ঘুরতে যাওয়া কোনো শহর।

২০২০ সালের ১৫ আগস্ট নিজ জেলা ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে জলঢোড়া, চিত্রিত ঢোড়া ও একটি মেটে সাপ উদ্ধার করেন মিজান। ৩০ আগস্ট কেরানীগঞ্জের বিসিক শিল্প নগরী এলাকা থেকে একটি হেলে সাপ উদ্ধার করে প্রকৃতিতে ছেড়ে দেন তিনি।

২০২১ সালের ১৪ অক্টোবর করোনার পর রাবির প্রত্যেকটি হলে তিনি সাপ বিষয়ক সচেতনামূলক পোস্টার সাঁটান। এতে শিক্ষার্থীদের সাপ না মেরে উদ্ধারের জন্য ফোন করার আহ্বান করা হয়। এ ছাড়াও সাপ হত্যা বন্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।

ক্যাম্পাসে এসব প্রচার-প্রচারণায় সাড়া দিয়ে প্রথম সাপ রেসকিউয়ের জন্য মিজানকে কল করা হয় বেগম খালেদা জিয়া হল থেকে। সেখানে উদ্ধারের বর্ণনা দিতে গিয়ে মিজান বলেন, ‘একটি ঘরগিন্নি সাপ ডাইনিংয়ের জানালার ফ্রেমের ভেতর ঢুকে ছিল। পরবর্তী সময়ে ফ্রেম ভেঙে সাপটি অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করি। পরে রাতেই নিরাপদ স্থানে অবমুক্ত করি।’

এরপর থেকে মাদার বখস হল, তাপসী রাবেয়া হল, শহিদ শামসুজ্জোহা হল, চারুকলা অনুষদ, পরিবহণ মার্কেট থেকে একে একে ১১টি সাপ উদ্ধার করেন তিনি। ২০২২ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত তিনি মোট পাঁচটি সাপ উদ্ধার করেছেন। যার মধ্যে একটি খৈয়া গোখড়া সাপও রয়েছে। যার কামড়ে ৫-৬ ঘণ্টার মধ্যে অনায়াসেই মারা যায় মানুষ।

এ ছাড়াও চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে সাপসহ প্রকৃতি নিয়ে ভাবা ও কাজ করতে ইচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০ শিক্ষার্থীকে ডিপ ইকোলজি অ্যান্ড স্নেক রেসকিউ ফাউন্ডেশনে সাধারণ মেম্বার হিসেবে যুক্ত করেন। তাদের প্রাথমিক বিষয়গুলো শেখানোর চেষ্টা করছেন মিজান। এসব মেম্বাররা প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য প্রস্তুত আছেন এবং ঈদের পরেই তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান তিনি। ভবিষ্যতে চাকরি কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য করার পাশাপাশি তার এ উদ্যোগ চালু থাকবে বলেও জানান এই শিক্ষার্থী।