-->

ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রুখবে কে

ভোরের আকাশ প্রতিবেদক
ডেঙ্গুর ভয়াবহতা রুখবে কে

দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর মিছিল থামছেই না। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার শনাক্তের পাশাপাশি ২১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ৮০ জনেরই মৃত্যু হয়েছে গত সেপ্টেম্বর মাসে। যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের বেশিরভাগই ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভারে ভুগছিলেন। এমনকি শক সিনড্রোম ও রোগীর শরীরে তরল ব্যবস্থাপনা (ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট) জটিলতায় তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এখন পর্যন্ত ৪২ হাজার ৪৭০ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন এবং মৃত্যু হয়েছে ২১৪ জনের।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শক সিনড্রোম ও ফ্লুইড ম্যানেজমেন্ট জটিলতায় বেশি মৃত্যু হলেও এর বাইরে দেরিতে হাসপাতালে আসা, চিকিৎসা পেতে বিলম্ব, দীর্ঘমেয়াদি জটিল রোগ এবং একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্তও দায়ী।

রুরাল (গ্রামীণ) এরিয়ার প্রাইমারি স্বাস্থ্যসেবার সব দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের হাতে থাকলেও আরবান (শহর) এরিয়ায় বড় একটি দায়িত্ব পালন করে সিটি করপোরেশন, যা দুই দপ্তরে এক ধরনের সমন্বয়হীনতা তৈরি করে। তাই ‘প্রাইমারি হেলথ কেয়ার’ নামক একটি পৃথক অধিদপ্তর করে এর অধীনে আরবান এরিয়ার প্রাইমারি হেলথকে নিয়ে আসার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. খোরশেদ আলী মিয়া। তিনি বলেন, আরবান এরিয়ায় প্রাইমারি হেলথ কেয়ার একটি নেগলেক্টেড ইস্যু। তাই ডেঙ্গু সংক্রমণ থেকে শুরু করে ‘নিয়ন্ত্রণযোগ্য’ নানা সংক্রমণ ও রোগ-বালাইকে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। তবে, প্রাইমারি হেলথ কেয়ারকে দেখাশোনার জন্য পৃথক একটি ডিরেক্টরেট হয়ে গেলে এবং এর মূল দায়িত্ব স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের হাতে চলে এলে ডেঙ্গুসহ নানা সমস্যার সমাধান চলে আসবে।

ডা. খোরশেদ আলী বলেন, একটা সময় শহর এলাকার রোগ নিয়ন্ত্রণ, রোগ নিরাময়, মশার ওষুধ ছিটানোসহ এ জাতীয় বিষয়গুলো মফস্বল এলাকাগুলোর মতোই স্বাস্থ্য বিভাগের অধীনে ছিল। কিন্তু আশির দশকের শেষ দিকে এটা সিটি করপোরেশনের অধীনে চলে যায়। আমরা যদি দেখি, রোগ প্রতিরোধ করার কার্যক্রমটা গ্রাম এলাকায় যতটুকু শক্তিশালী, শহুরে এলাকায় অতটা না। এজন্য আমি মনে করি পলিসি লেভেলে একটা বড় ধরনের পরিবর্তন আনা উচিত এবং স্বাস্থ্য বিভাগকে আরও শক্তিশালী করা উচিত। তিনি বলেন, প্রাইমারি হেলথ কেয়ার কখনোই সিটি করপোরেশনের কাজ নয়। সিটি করপোরেশনের এমনিতেই অনেক কাজ। ওয়াসা-পুলিশিং থেকে শুরু করে নানা কার্যক্রমে তাদের বিস্তৃতি অনেক। যে কারণে এত কাজের মধ্যে স্বাস্থ্যের বিষয়টা তাদের কাছে অনেকটা নেগলেক্টেড ইস্যু। এ জায়গাগুলোতে স্বাস্থ্য বিভাগের কোনো কাজই নেই। যে কারণে শহর এলাকাগুলোতে প্রাইমারি হেলথ কেয়ারের বিষয়টা অনেকটা এতিমের মতো পড়ে আছে। এজন্য আমরা চাইব প্রাইমারি হেলথ কেয়ার থেকে একটা ডিরেক্টরেট করে এর অধীনে আরবান এরিয়ার প্রাইমারি হেলথকে নিয়ে আসা হোক। তাহলে আমাদের ডেঙ্গু সমস্যার মতো আরও অনেক সমস্যাই সমাধান হয়ে যাবে।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান- আইইডিসিআর গত এক মাস ধরে ডেঙ্গুর সেরোটাইপ নিয়ে গবেষণা করছে। এতে দেখা গেছে, এবারও ডেঙ্গুর চার সেরোটাইপ বা ধরনের মধ্যে ‘ডেন-২’ এর প্রাধান্য বেশি। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) ডেঙ্গু পজিটিভ ৪০ রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে সেখানে ৬৯ দশমিক ২০ শতাংশ ডেন-২ এর উপস্থিতি পেয়েছে। তবে, পরপর দুই বছর একই সেরোটাইপ বা ধরন প্রভাব বিস্তার করায় চলতি বছর ডেঙ্গুর ভয়াবহতা কম দেখছেন গবেষকরা। এর বাইরে ২০ দশমিক ৫০ শতাংশ ডেন-৩ শতাংশ, ১০ দশমিক ৩০ শতাংশ রোগী ডেন-৪ আক্রান্ত। তবে, বিশ্লেষণে ডেন-১ আক্রান্ত কোনো রোগী পাওয়া যায়নি।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সাইফুল্লাহ বলেন, এখন অধিকাংশ রোগী শক সিনড্রোমের লক্ষণ নিয়ে হাসপাতালে আসছেন। রক্তক্ষরণ ও শরীরে পানি শূন্যতার কারণে রোগী অচেতন হয়ে পড়ছেন। অনেক রোগী স্পষ্ট করে কথা বলতে পারছেন না। কারও কারও পায়খানার সঙ্গে রক্ত আসছে। এসব রোগীর ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা জরুরি। তবে, অনেক ক্ষেত্রে সঠিকভাবে ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হচ্ছে না। তিনি বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন বা সেরোটাইপ আছে। এর মধ্যে এবার ডেন-২ তে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। অনেক রোগী একাধিকবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। গত বছরও শক সিনড্রোমে বেশি মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। তিনি বলেন, এখন ডেঙ্গু রোগীর ক্ষেত্রে আমরা দুটি বিষয়ে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি। শক সিনড্রোম ও ফ্লুইড ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু রোগীর শারীরিক অবস্থা জটিল হওয়ার আগেই হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ এ বিশেষজ্ঞের।

ঢাকা মেডিকেল কলেজের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. কাকলী হালদার বলেন, সাধারণত যারা দ্বিতীয় বা তার বেশি বার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন তারাই ডেঙ্গু শক সিনড্রোমে বা হেমোরেজিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন। তাদের আইসিইউর প্রয়োজন হতে পারে এবং মৃত্যুঝুঁকিও বেড়ে যায়। তবে, প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু ফিভারে রোগী সাধারণত পাঁচ-সাত দিনের মধ্যে ভালো হয়ে যান। তিনি বলেন, সাধারণত জ্বর থাকা অবস্থায় ডেঙ্গু রোগী মারা যায় না বা জটিলতা শুরু হয় না। বরং বিপদ শুরু হয় আসলে চার দিন পরে জ্বর কমার পর। আগে সাধারণত পাঁচ-ছয় দিনের সময় ক্রিটিক্যাল ফেইজ শুরু হতো, কিন্তু এখন তিন দিনের শুরুতেই অনেক রোগী শকে চলে যাচ্ছেন। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে দুই দিন পরেও হতে পারে। আবার অল্প জ্বর থাকা অবস্থায়ও অনেকের শারীরিক অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তাই জ্বর কমে গেলে আরও সতর্ক হতে হবে। কারণ, এ সময় রক্তে প্লাটিলেটও দ্রুত কমতে শুরু করে।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version