-->

এইচআইভি এবং এক তরুণের যুদ্ধ

সুহানুর রহমান
এইচআইভি এবং এক তরুণের যুদ্ধ

রুমের ভেতরে এসি চলছে। তবু ঘামে ভিজে সিক্ত ভার্সিটি পড়ুয়া তরুণ রাহাত তরফদার (ছদ্মনাম)। তার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ। এরমধ্যেই ডাক্তারের কণ্ঠ। ‘চিন্তা করো না ইয়ংম্যান। তুমি আরও ৯০ বছর বাঁচবে। এই রোগ মানেই মৃত্যু, তা ঠিক না।’ কিন্তু কথাগুলো বিশ্বাস হয়নি রাহাতের। মনে হচ্ছিলো, ডাক্তার তাকে মিথ্যা সান্ত্বনা দিচ্ছেন। এটি মরণব্যাধি ভাইরাস। আক্রান্ত হলে মানুষ বাঁচে না। রাহাত ভাবছিলেন, তিনি হয়তো শিগগিরই মারা যাবেন। তার আগে ঘটবে অনেক ঘটনা। বাসা থেকে বের করে দেয়া হবে তাকে। মা-বাবা, বোন, আত্মীয়-স্বজন সবাই তাকে দূরে ঠেলে দেবে। কেউ আশ্রয় দেবে না। ভাবছিলেন আর পুরো শরীর কাঁপছিলো। কথা আটকে যাচ্ছিলো। ঘাম ঝরছিলো। ডাক্তার সাহস দিচ্ছিলেন। একপর্যায়ে ডাক্তারের সামনেই হাউমাউ করে কাঁদতে থাকেন তিনি।

 

ঘটনাটি ২০২০ সালের। সেদিনই প্রথম রাহাত জানতে পারেন তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। ঢাকার সাভারের বাসিন্দা রাহাত। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। বয়স তখন ২২ বছর। এই বয়সেই এক অন্যরকম যুদ্ধে নামতে হয় তাকে। বাবা চাকরিজীবী, মা গৃহিণী। তাদের তিন সন্তান। এরমধ্যে একমাত্র পুত্র রাহাত। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিকে এই সমাজ ভালো চোখে দেখে না। সামাজিক নানা লাঞ্চনার শিকার হতে পারেন তিনি। তাই সিদ্ধান্ত নেন বিষয়টি কোনোভাবেই কাউকে জানতে দেবেন না।

 

চিকিৎসক তাকে মানসিক শক্তি দেন। সাহস যোগান। কিন্তু শুরুতে ওই প্রতিষ্ঠানেই নেতিবাচক অভিজ্ঞতা অর্জন করেন রাহাত। অসুস্থ হওয়ার পর ওই প্রতিষ্ঠানে যান তিনি। এ বিষয়ে রাহাত জানান, অসুস্থ বোধ করছিলেন। ঘাড়ের দু’দিক ফুলে গেছে। প্রতি রাতেই জ্বর আসে। ডায়রিয়া হচ্ছে। ভীষণ ক্লান্তি লাগে। ওষুধ সেবন করছেন কিন্তু সুস্থ হচ্ছেন না। তখনই সন্দেহ জাগে। একাদশ শ্রেণিতে ‘অপরাহ্ণের গল্প’ পড়েছেন, তখন থেকেই এইচআইভি সম্পর্কে একটু আধটু ধারণা তার। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খোঁজে পান এই সংক্রান্ত চিকিৎসা প্রদান করে এমন একটি প্রতিষ্ঠানের ফোন নম্বর। যোগাযোগ করে ছুটে যান মগবাজারে।

 

কথা হয় ওই প্রতিষ্ঠানের কাউন্সিলরের সঙ্গে। সুদর্শনা নারী। মুখোমুখি বসে জানতে চান, কেন টেস্ট করাতে চাচ্ছেন, তিনি অনিরাপদ যৌনসম্পর্ক করেন কি-না? রাহাত মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক জবাব দেন। তরুণী জানতে চান, যৌনপল্লীতে, হোটেলে যৌনকর্মীদের কাছে যেতেন কি-না। রাহাত বলেন, না। তরুণী আবার জানতে চান, তাহলে কি গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে? অনিক না- সূচক মাথা নাড়ান। তরুণীর চোখে-মুখে বিস্ময়। তাহলে কার সঙ্গে ফিজিক্যাল সম্পর্ক করতেন?

 

রাহাত মাথা নিচু করে জানান, তিনি হোমোসেক্স করতেন। তরুণী হতভম্ব হয়ে যান। সঙ্গে সঙ্গে চেয়ারটি দূরে সরিয়ে নেন। তার চোখে কোনো সহানুভূতি নেই। সেদিন রক্ত পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরে যান রাহাত। কথা ছিল রক্ত পরীক্ষার রিপোর্ট এলে ফোনে তাকে জানানো হবে। তৃতীয় দিন ফোনে ডাকা হয় তাকে। রাহাত উপস্থিত হন সেই অফিসে। এবার সেই তরুণী তাকে ডেকে নিয়ে সাহস দেন। তারপরই জানান, তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। বুঝানোর চেষ্টা করেন। এটি একটি অসুখ ছাড়া কিছুই না। নিয়মিত চিকিৎসা গ্রহণ করলে নিয়ন্ত্রণে থাকবে। সংসার, কাজ সবই করা যাবে। দীর্ঘদিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যাবে।

 

তারপরই তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ডাক্তারের কাছে। দ্রুত সিডি ফোর পরীক্ষা করানো হয়। চিকিৎসকরা জানান, এটি রক্তের শ্বেতকণিকার একটি উপাদান। প্রতি ঘন মিলিমিটার রক্তে সাধারণত ৯০০ থেকে ১২০০ সিডি ফোর থাকে। এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তির রক্তে সিডি ফোর উপাদান কমতে থাকে এবং সেই সঙ্গে তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে। রক্তে সিডি ফোরের পরিমাণ ২০০-এর নিচে নেমে গেলে তাকে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি দিতে হয়। পরীক্ষায় জানা যায়, রাহাতের সিডি ফোর ৩৪০। তারপর শুরু হয় চিকিৎসা। একটা যুদ্ধ।

 

অসচেতনতার কারণেই তিনি এইচআইভি আক্রান্ত হন বলে তার ধারণা। শুরুতে ‘আশার আলো সোসাইটি’তে চিকিৎসা নিয়েছেন রাহাত। পরে চিকিৎসা নেন ‘বন্ধু সোশ্যাল ওয়েল ফেয়ার সোসাইটি’তে। দুটি প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসকরা তাকে সেবা দিয়ে আশার আলো দেখিয়েছেন। রাহাত জানান, এখন তার সিডি ফোর ৯০০। সুস্থ মানুষের মতোই। কিন্তু তার পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সহপাঠী কেউ জানেন না তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। রাহাত বলেন, জানাজানি হলে আমি এই সমাজে চলতে পারবো না। এমনকি নিজের পরিবারেও থাকতে পারবো না। এইচআইভি আক্রান্তদের নিয়ে তাদের অনেক ভুল ধারণা। রাহাত জানান, এখন তিনি এ বিষয়ে একটা উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করছেন। জনসচেতনতা তৈরির কাজ। মানুষের সেবা করাই রাহাতের উদ্দেশ্য। অসেচতনতার কারণেই এইচআইভি বা এইডসে আক্রান্ত হচ্ছেন এ দেশের মানুষ।

 

এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, এইচআইভি বা এইডস জন্মগত বা ছোঁয়াচে রোগ না। যে কোনো ব্যক্তিই এইচআইভি সংক্রমণের ঝুঁকিতে থাকে। এইচআইভি বিভিন্নভাবে ছড়িয়ে থাকে। আক্রান্ত ব্যক্তির সঙ্গে অনিরাপদ যৌন সম্পর্ক স্থাপন থেকে হতে পারে। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত গ্রহণ, আক্রান্ত মা থেকে তার শিশুতে, আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত সিরিঞ্জ অন্যজন ব্যবহারের মাধ্যমেও এইচআইভি ছড়াতে পারে। ড. অরূপরতন চৌধুরী জানান, এ দেশের ২৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারীই এইডস বিষয়ে অবগত নন। এক্ষেত্রে সচেতনতার হার বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি সাবধানতা অবলম্বন করা আবশ্যক বলে মনে করেন তিনি।

 

জাতীয় এইডস-এসটিডি প্রোগ্রামের তথ্যানুসারে বাংলাদেশে এই রোগের আক্রান্তের সংখ্যা ১৪ হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে চিকিৎসার আওতায় এসেছে ৮৪ শতাংশ। এ পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে এইডসের কারণে। ১৯৮৯ সালে দেশে প্রথম এইচআইভি আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করা হয়।

 

ভোরের আকাশ/অ

মন্তব্য

Beta version