-->

মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

নিখিল মানখিন
মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের হুমকিতে জনস্বাস্থ্য

নিখিল মানখিন: অনেক আগেই হয়ে গেছে মেয়াদোত্তীর্ণ। সুযোগ পেলেই ওইসব ওষুধ তুলে দেয়া হতো ক্রেতার হাতে। সোমবার এমন অপরাধে ফরিদপুরের নগরকান্দায় পাঁচ ব্যবসায়ীকে অর্থ জরিমানা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। দুপুরে উপজেলার সদর বাজারের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে এ আদেশ দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মঈনুল হক।

 

এভাবে শুধু ফরিদপুরের নগরকান্দায় নয়, দেশের সব জায়গায় মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির ঘটনা বেড়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ নিয়ে হয়রানি থেকে রেহাই পাচ্ছে না সাধারণ মানুষ। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে লেভেল লাগিয়ে মেয়াদ বৃদ্ধির কারসাজিও চলে। জনবল সংকটে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পক্ষেও সারা দেশের হাজার হাজার ফার্মেসি ঘুরে দেখাও সম্ভব হয়ে ওঠে না। মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।

 

গত ৩১ মে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির অপরাধে ৮ ফার্মেসিকে জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। উপজেলার বিভিন্ন বাজারের ফার্মেসিতে অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত এই জরিমানা করেন।

 

চট্টগ্রাম জেলার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এতে সহায়তা করে। অভিযানে নেতৃত্ব দেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান ও চট্টগ্রাম জেলার ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক এস এম সুলতানুল আরেফিন। অর্থদন্ডের ৮ ফার্মেসি হলো উপজেলা সদরের রিমা মেডিকেল হল, মীর মেডিসিন হল, আলিফ মেডিকেল হল, জাহেদা মেডিকেল হল;

 

এছাড়াও উপজেলার মস্তাননগর এলাকায় পপুলার মেডিকেল হল, ফাহাদ মেডিকেল হল, মেসার্স তবারুক মেডিকেল ও মেসার্স মস্তাননগর মেডিকেল হল।

 

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, এসব ফার্মেসিতে অনুমোদনহীন ওষুধ বিক্রির পাশাপাশি নিয়মবর্হিভূত ভাবে প্রেসক্রিপশন ও ড্রাগ আইন লঙ্ঘনের দায়ে ৯ ফার্মেসিকে জরিমানা করা হয়।

 

এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট। আর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধে লেভেল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখার অপরাধে গত ৮ মে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় দুই ফার্মেসিকে অর্থ জরিমানা করেন ভ্রাম্যমাণ আদালত।

 

উপজেলার পাটগাতী বাজারে বিভিন্ন ওষুধের দোকানে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেন সহকারী কমিশনার (ভ‚মি) মীর কামরুজ্জামান কবির ও গোপালগঞ্জের ড্রাগ সুপার বীথি রানী মন্ডল। এ সময় টুঙ্গিপাড়া থানার পুলিশ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

 

সহকারী কমিশনার (ভূমি) মীর কামরুজ্জামান কবির সাংবাদিকদের জানান, মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ, কসমেটিকস সামগ্রী ও হাঁস-মুরগির ওষুধ রাখার অপরাধে পাটগাতী বাজারের বিকে ফার্মেসিকে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। এছাড়া মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রাখায় রায় ফার্মেসিকে তিন হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করার পর মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ জব্দ করে নষ্ট করা হয়েছে। পাশাপাশি এ ধরনের কর্মকান্ড থেকে বিরত থাকার জন্য তাদের সতর্ক করা হয়েছে। জনসচেতনতার পাশাপাশি নিয়মিত ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে বলেও জানান ওই কর্মকর্তা। এভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি সারা দেশে।

 

ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ পরিচালিত এক প্রতিবেদনে রাজধানীর শতকরা ৯৩ ভাগ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ রয়েছে ও বিক্রি হচ্ছে বলে এক সেমিনারে জানানো হলে সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। উচ্চ আদালত শিগগির বাজার থেকে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ প্রত্যাহারের নির্দেশ দেন।

 

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা ভোরের আকাশকে বলেন, ওষুধের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু বিভিন্ন ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ থাকাটা অস্বাভাবিক। প্রচলিত নিয়ম অনুসারে যে কোনো ওষুধ মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর ফার্মেসিগুলো তা একটি নির্দিষ্ট কনটেইনারে মজুত রাখে এবং ওই কনটেইনারে ‘এ ওষুধ বিক্রির জন্য নয়’ লেখা থাকে বলে জানান অধিদপ্তরের ওই কর্মকর্তা।

 

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মান বিবেচনা করে ওষুধের দোকানের নিবন্ধন দেয়া উচিত। যে কেউ আবেদন করলে নিবন্ধন পাওয়ার কথা নয়। এসব বিবেচনা করে মডেল ফার্মেসি, মডেল মেডিসিন শপ শ্রেণিতে নিবন্ধন দেয়া শুরু হয়েছিল।

 

ফার্মেসি থেকে ওষুধ বিতরণ হয়। এতে সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করতে হয়। ফার্মেসিগুলো সঠিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ করতে হয়। মাত্র পাঁচ মাসে এতসংখ্যক ফার্মেসি নিবন্ধন দেয়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের বলেন, জনগণের স্বাস্থ্য নিয়ে কাউকে ছিনিমিনি খেলতে দেয়া হবে না। নকল, ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ কোথাও যেন বিক্রি না হয় সেজন্য ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর সব সময় সতর্ক দৃষ্টি রাখছে, রাখবে বলে মন্তব্য করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে জানান, যে কোনো ভেজাল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্ন মানের ওষুধ নেয়াই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মান ঠিক না থাকলে গ্রহণকারীর মারাত্মক পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। এ ধরনের ওষুধ ব্যবহারকারীরা নানা জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। এমনকি মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। মানবর্হিভূত ওষুধ এড়িয়ে চলার জন্য জনসাধারণকে পরামর্শ দেন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ভোরের আকাশকে জানান, ভেজাল রোধ করতে হলে নিয়মিত মনিটরিংয়ের বিকল্প নেই। যে কোনোভাবে মনিটরিং ব্যবস্থা সচল রাখতে হবে। জেলা পর্যায়ে সম্ভব না হলেও বিভাগীয় পর্যায়ে ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরি গড়ে তুলতে হবে। শুধু গড়ে তুললেই হবে না, জনবল ও পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি দিয়ে ল্যাবগুলো গতিশীল করে তুলতে হবে।

 

এ বিষয়ে যথাযথ সরকারি সিদ্ধান্ত ও পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোম্পানিকে সঠিক মানের ওষুধ বানাতে বাধ্য করতে হবে। শুধু তাই নয়, ওষুধ প্রশাসনের লোকজন যাতে প্রভাবিত না হতে পারেন, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। ড্রাগ টেস্টিং ল্যাবরেটরিকে স্বায়ত্তশাসিত ক্ষমতা দেয়ার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ল্যাব হবে পুরোপুরিই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। এ প্রতিষ্ঠানকে সব ধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও হুমকি থেকে মুক্ত রাখতে হবে।

 

তিনি বলেন, দেশে এখনো ভালো ওষুধ কোম্পানির সংখ্যাই বেশি। তবে কিছু কিছু কোম্পানি মানহীন ওষুধ তৈরি করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version