স্বাস্থ্যখাতে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে আগের অর্থ বছরের তুলনায় বরাদ্দ বেড়েছে ১১৮৯ কোটি টাকা। প্রস্তাবিত বাজেটে ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের জন্য সরকার ৩৮ হাজার ৫২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যা শতকরা বিবেচনায় মোট প্রস্তাবিত বাজেটের ৫ দশমিক ৯ শতাংশ। চলমান ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৮৬৩ কোটি টাকা।
বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপনে এ তথ্য জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, মানসম্মত ও জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা বর্তমান সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার। এ অঙ্গীকার বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে সরকার। বিশেষ করে, কোভিডকালীন স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় উন্নয়ন সহযোগীদের নিকট হতে পর্যাপ্ত অর্থায়ন সংগ্রহ ও তার ব্যবস্থাপনা, দ্রুত তম সময়ে ভ্যাকসিন ক্রয় ও প্রয়োগ করা হয়েছে। জনগণকে কোভিড-১৯ এর ভ্যাকসিন প্রদান বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম পঞ্চম দেশের মধ্যে অবস্থান করছে।
কোভিড পরিস্থিতি পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ: অর্থমন্ত্রী বলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে ১৬টি জাতীয় গাইডলাইন, অন্যান্য নির্দেশিকা, ৪টি এসওপি (অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং প্রসিডিউর) এবং ১৩টি গণসচেতনতামূলক উপকরণ তৈরি করা হয়েছে। কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলিতে ১২ হাজার ৮৬০টি শয্যা এবং ১ হাজার ১৮৬টি আইসিইউ'র সংস্থান করা হয়েছে। দেশের সকল জেলা হাসপাতাল, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বিশেষায়িত হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
মোস্তফা কামাল বলেন, সকল জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে হাসপাতালে কমপক্ষে ৫টি শয্যা কোভিড রোগীদের জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।প্রয়োজন অনুযায়ী ভবিষ্যতে এ সংখ্যা বৃদ্ধি করা হবে। মোবাইল ফোনে কোভিড-১৯ এর সেবা প্রদান ও স্বাস্থ্য বাতায়নসহ অন্যান্য হটলাইনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছি আমরা। সারাদেশে ১৬২টি পরীক্ষাগারে আরটিপিসিআর টেস্ট করা হচ্ছে।
এছাড়াও ৫৭টি জিন এক্সপার্ট মেশিনের মাধ্যমে এবং ৬৬৬টি কোভিড-১৯ র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট সেন্টারের মাধ্যমে কোভিড-১৯ টেস্ট করা হচ্ছে।
সবার জন্য সুলভ ও মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা: অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সহস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে সাফল্যের ধারাবাহিকতায় টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টসমূহ অর্জনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্যখাতে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট অর্জনের মূল বৈশিষ্ট্য হল- অগ্রাধিকারভিত্তিক সেবাসমূহ সম্প্রসারণ, অধিক সংখ্যায় জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্তকরণ ও সেবাগ্রহীতার ব্যক্তিগত ব্যয় হ্রাসকরণ।
এক কথায় আর্থিক কষ্ট ব্যতিরেকেই সকল নাগরিকের জন্য গুণগত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির বিষয়টি নিশ্চিত করা। এ লক্ষ্যের সাথে সামঞ্জস্য রেখে আমরা চতুর্থ স্বাস্থ্য, ও পুষ্টিখাত কর্মসূচির আওতায় ৩১টি অপারেশনাল প্ল্যানের মাধ্যমে সারাদেশে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছি।
তিনি বলেন, প্রতিরোধযোগ্য রোগসমূহ হতে শিশুদের সুরক্ষা দিতে চলমান রাখা হয়েছে সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)। ১৯৮৫ সালে ইপিআই কভারেজ ছিল মাত্র ২ শতাংশ, যা বর্তমানে ৯৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১০৬টি উপজেলায় মাল্টিপারপাস হেলথ (এমএইচভি) কার্যক্রম বাস্তবায়িত হচ্ছে।
দরিদ্র জন্য পরীক্ষামূলকভাবে স্বাস্থ্যসুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় টাঙ্গাইল জেলার ১১টি আন্তঃবিভাগীয় রোগীদের (স্বাস্থ্য সুরক্ষা কর্মসূচি) বেনিফিট প্যাকেজের অধীনে ৭৮টি নির্ধারিত রোগের মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি ক্লিনিক: মোস্তফা কামাল বলেন, গ্রামীণ জনগণের কাছে সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর কার্যকর মাধ্যম হিসেবে আমরা এ পর্যন্ত ১৪ হাজার ৩৮৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছি। কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সরকার ও জনগণের সম্মিলিত অংশীদারিত্বে পরিচালিত হয়।
ক্লিনিকের জন্য জমি প্রদানের পাশাপাশি স্থানীয় বাসিন্দারা ক্লিনিকের ব্যবস্থাপনায়ও ভূমিকা রাখেন। ক্লিনিক পরিচালনা ও ওষুধ-চিকিৎসা সরঞ্জামের ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব সরকারের। ক্লিনিকে মা, নবজাতক ও অসুস্থ শিশুর সমন্বিত সেবা (আইএমসিআই), প্রজননস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা, সাধারণ আঘাতের চিকিৎসা ছাড়াও পুষ্টিসেবা প্রদান করা হয়।
তিনি বলেন, ক্লিনিকে ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপের মতো অসংক্রামক রোগ শনাক্ত করা হয়। বয়স্ক, কিশোর-কিশোরী ও প্রতিবন্ধীদের লক্ষণভিত্তিক চিকিৎসা ও পরামর্শ দেওয়া হয়। ক্লিনিক থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ ছাড়াও শিশুদের অনুপুষ্টিকণার প্যাকেট দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী কমিউনিটি ক্লিনিকে বিনা পয়সায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইনসুলিন প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছেন।
প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে দৈনিক গড়ে ৪০ জন সেবাপ্রার্থী সেবা গ্রহণ করে থাকেন, যার ৮০ শতাংশই নারী ও শিশু। সারাদেশে প্রায় ৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবসেবা দেওয়া হয়।
স্বাস্থ্যখাতে অবকাঠামো উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ: অর্থমন্ত্রী বলেন, সাধারণ জনগণের জন্য উন্নত চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৫০ শয্যা হতে ১০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, ৬টি জেলা সদর হাসপাতালকে ১০০ শয্যা হতে ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শয্যা সংখ্যা ১ হাজার ৩১৩ হতে ২ হাজার ২০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ৪১৪টি শয্যা বৃদ্ধি করে ১ হাজার ২৫০ শয্যায় উন্নীতকরণ, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কিডনী ডিজিজেস এন্ড ইউরোলজী ঢাকার শয্যা সংখ্যা ২০০ হতে ৫০০ শয্যায় উন্নীতকরণ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে ২০০ শয্যা বৃদ্ধিপূর্বক ৪০০ শয্যায় উন্নীতকরণ করা হবে।
ইতোমধ্যে ৫০০ শয্যাবিশিষ্ট শহিদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল সিরাজগঞ্জ-এ সেবা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যও চিকিৎসাসেবা প্রদানের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে স্কিন ব্যাংক এর কার্যক্রম শুরু হয়েছে ও একটি লিম্ব সেন্টার স্থাপনের কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
অর্থমন্ত্রী মুস্তফা কামাল বলেন, স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও জনসংখ্যা খাতে প্রেক্ষিত পরিকল্পনা ২০২১-২০৪১ এর অন্যতম কৌশল হল স্বাস্থ্যসেবা খাতে নিয়োজিত জনবলের সংখ্যা ও গুণগত মানের উন্নয়ন সাধন। এ পরিকল্পনা ও জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১ এর সাথে সামঞ্জস্য রেখে চিকিৎসা ও নার্সিং শিক্ষা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মানোন্নয়ন ও আধুনিকায়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।
চিকিৎসা শিক্ষায় সকল স্নাতকোত্তর ডিগ্রিকে এক প্লাটফরমের আওতায় নিয়ে আসা, পরীক্ষা পদ্ধতির আধুনিকায়ন, শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। পাশাপাশি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার অবকাঠামো তৈরি, গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করা, স্বাস্থ্য খাতের নতুন উদ্ভাবনের সক্ষমতা বৃদ্ধি ইত্যাদির উদ্দেশ্যে ‘সমন্বিত স্বাস্থ্য-বিজ্ঞান গবেষণা ও উন্নয়ন তহবিল' এ বরাদ্দ প্রদান অব্যাহত রেখেছি।
অদূর ভবিষ্যতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যবহৃত বিশেষায়িত প্রযুক্তি/যন্ত্র ব্যবহার, পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষায়িত ও দক্ষ জনবল তৈরির জন্য কোর্স/প্রশিক্ষণ পরিচালনাসহ উপযোগী অন্যান্য কার্যক্রম গ্রহণের চিন্তাভাবনা আছে আমাদের।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য