-->

একই সময়ে অবনতি ঘটছে ডেঙ্গু ও করোনার

নিখিল মানখিন
একই সময়ে অবনতি ঘটছে ডেঙ্গু ও করোনার

নিখিল মানখিন: দ্রুত অবনতি ঘটছে দেশের করোনা এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতির। করোনা ও ডেঙ্গুর বেশকিছু উপসর্গের মিল থাকায় বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

 

তারা বলছেন, করোনা মানুষের রক্তে যে সমস্যা তৈরি করে, তেমনি রক্তে একই রকম সমস্যা তৈরি করে ডেঙ্গু। আর একই ব্যক্তি করোনা ও ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হলে ওই রোগীর মৃত্যুঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রাজধানীতেই করোনা ও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশি। তাই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতন থাকার পরামর্শ দিয়েছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফুরিয়ে যায়নি করোনা মহামারির ক্ষত। বিশ্বের অনেক দেশে এখনো করোনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। মৃত্যুর ঘটনা না থাকলেও বাংলাদেশে বেড়েছে নতুন করোনা রোগী শনাক্তের হার।

 

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দৈনিক শনাক্তকৃত নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা একশর উপরে অবস্থান করছে। উপসর্গ নিয়েও করোনা শনাক্ত করাতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না মানুষ। তারপরও দৈনিক করোনা শনাক্তের হার ৬ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় শনাক্ত হয়েছেন নতুন ১০৩ জন করোনা রোগী।

 

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনা পরিস্থিতির অবনতির মধ্যে ডেঙ্গুজ্বরের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় জনমনে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে গেছে। এপ্রিল-মে থেকে শুরু করে সেপ্টেম্বর-অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর মৌসুম। এটা প্রতি বছর হয়েই থাকে, ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতাও আমাদের আছে।

 

গত ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল ডেঙ্গু। সরকারি হিসাবেই ওই বছর হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। মারা গেছেন ২৬৬ জন।

 

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট আক্রান্ত সংখ্যার ভিত্তিতে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের ডেঙ্গুতে মুত্যুহার ১৩ গুণ এবং আক্রান্ত বেড়েছে ৫ গুণ। গত পাঁচ মাসের অবনতির ধারা অব্যাহত থাকলে পিক মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

 

করোনা ও ডেঙ্গু: প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, ডেঙ্গু ও করোনা দুটিতেই আক্রান্ত হওয়ার রোগী পাওয়া যাচ্ছে। জ্বর হলেই প্রথমে করোনা ও পরে ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে।

 

এক্ষেত্রে উদাসীনতা ও খামখেয়ালিপনা করলে মৃত্যুর আশঙ্কা রয়েছে।

 

তিনি বলেন, করোনা ও ডেঙ্গু এ দুটির উপসর্গ প্রায় একই। তবে কিছু কিছু পার্থক্য আছে। করোনার উপসর্গ হলো জ্বর, সর্দি, কাশি, গলাব্যথা, শ্বাস কষ্ট, শরীরে ব্যথা ও ঘ্রাণ না পাওয়া। আর ডেঙ্গুর লক্ষণ হলো, ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি শরীর কাঁপানো জ্বর, চোখের পাতার পেছনে ব্যথা ও ব্যাপক পেইন এবং গিরায় গিরায় ব্যথা। শরীরে র‌্যাশও উঠতে পারে।

 

কোনো কোনো ডেঙ্গু রোগী আক্রান্ত হওয়ার চার দিন পর প্লাটিলেট কমে গিয়ে নাক, দাঁত, পায়খানা ও বমির মাধ্যমে রক্তক্ষরণ হতে পারে। করোনা রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ চিকিৎসা সেবায় প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু ডেঙ্গু রোগীর শুধু প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ খেতে হবে, এসপিরিন জাতীয় ওষুধসহ কোনো ধরনের ব্যথানাশক ওষুধ সেবন করা যাবে না।

 

তবে সেকেন্ডারি ইনফেকশন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক খেতে হতে পারে। এছাড়া ডেঙ্গু রোগীকে বেশি করে ওরস্যালাইন, ডাব ও অতিরিক্ত পানি খাওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আরো বলেন, এডিস মশার কারণে ডেঙ্গুজ্বর হয়। এডিস মশা দিনে কামড়ায়। শীত না আসা পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব থাকতে পারে।

 

আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর ভোরের আকাশকে বলেন, ডেঙ্গু ও করোনার উপসর্গ প্রায় একই। তবে কিছু পার্থক্য আছে। দুটির ক্ষেত্রেই জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, কাশি এবং স্বাদ না থাকতে পারে। করোনার ক্ষেত্রে এসব লক্ষণের সঙ্গে নাকে ঘ্রাণ পায় না এবং কারো কারো পাতলা পায়খানা হয়।

 

এছাড়া করোনার ক্ষেত্রে শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা হতে পারে, যেটি ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে হয় না। ডেঙ্গুজ্বরের ক্ষেত্রে চার-পাঁচ দিন পরে শরীরে লাল অ্যালার্জির মতো র‌্যাশ হতে পারে। তখন রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রা কমে যেতে পারে।

 

তিনি বলেন, একজন রোগীর ডেঙ্গু ও করোনা এক সঙ্গে হচ্ছে। তাই জ্বর হলেই করোনার পাশাপাশি ডেঙ্গু পরীক্ষা করা বাধ্যতামূলক। নিজের জীবন রক্ষার স্বার্থে দুটি পরীক্ষা করাতে হবে।

 

ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল ইসলাম বলছেন, যদি একইসঙ্গে ডেঙ্গুর কারণে রক্তে প্লাটিলেট স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি কমে যায় এবং কোভিডের কারণে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রাও ৯০-এর নিচে নেমে যায়, তাহলে বিষয়টি বিপজ্জনক। তখন একইসঙ্গে প্লাটিলেট দিতে হবে, অক্সিজেন দিতে হবে। চিকিৎসকরা এর সিদ্ধান্ত নেবেন।

 

আবার করোনার কারণে যদি ফুসফুস বেশি আক্রান্ত হয়, হৃদযন্ত্রের আর্টারি আক্রান্ত হয়, তখন খুবই দুশ্চিন্তার বিষয়। এমন রোগীদের ফেরানো মুশকিল।

 

করোনা পরিস্থিতির বিষয়ে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, করোনার সংক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। সতর্ক থাকতে হবে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে। এক বছরেরও বেশি সময় পর দেশে ফের করোনা টিকার বুস্টার ডোজ দেয়া শুরু হচ্ছে।

 

চলতি সপ্তাহেই দেশের সিটি করপোরেশন, জেলা, উপজেলা ও পৌরসভায় করোনার টিকা কেন্দ্র থেকে দেয়া শুরু হবে। এই সপ্তাহ থেকে শুরু হয়ে যাবে। আমরা টিকা ট্রায়ালের সম্পন্ন করেছি। ইমেডিয়েটলি দেয়া হবে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির ভোরের আকাশকে বলেন, আগাম বৃষ্টির কারণে এ মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা বেশি। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ১৩ জন। আক্রান্তের সংখ্যাও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি।

 

শুরুতেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ডেঙ্গু পরীক্ষাসহ চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। এই গাইডলাইন অনুযায়ী সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে।

 

তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি বাবদ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নিতে পারবে। এর চেয়ে বেশি নেয়া হলে ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version