-->

বছরজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক

নিখিল মানখিন
বছরজুড়ে ডেঙ্গু আতঙ্ক

নিখিল মানখিন: বছরজুড়ে থাকছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। মৌসুম মানছে না ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব। এতদিন জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত পাঁচ মাস সময়কে ডেঙ্গুর মৌসুম বলে উল্লেখ করে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সারা বছরই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মোট আক্রান্ত সংখ্যার ভিত্তিতে ২০২২ সালের তুলনায় ২০২৩ সালের ডেঙ্গুতে মুত্যুহার ১৩ গুণ এবং আক্রান্ত বেড়েছে ৫ গুণ। গত পাঁচ মাসের অবনতির ধারা অব্যাহত থাকলে পিক মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গত ২০১৯ সালে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল ডেঙ্গু। কিন্তু ২০১৯ সালে এক লাখের বেশি ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা যান ১৭৯ জন। আর ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জনের বেশি আক্রান্ত হয়ে মারা যান ২৮০ জন। অর্থাৎ ২০১৯ সালে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুহার কম এবং ২০২২ সালে আক্রান্তের তুলনায় মৃত্যুর হার বেশি ছিল। আর ২০২৩ সালের প্রথম মাসেই উদ্বেগজনক ডেঙ্গু রোগী এবং মৃত্যুর ঘটনা যেন দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতির অবনতির আগাম বার্তা দিয়েছে। মোট আক্রান্তের বিবেচনায় ২০১৯ সালে মৃত্যুহার শূন্য দশমিক ১৭, ২০২২ সালে শূন্য দশমিক ৪৪ এবং ২০২৩ সালের গত পাঁচ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১ দশমিক ৪১ শতাংশ। গত পাঁচ মাসে ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার হার গত ১৫ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মারা গেছেন যথাক্রমে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন ও ৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ ও ৩ জন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ ও ২ জন এবং মে মাসে (২৯ তারিখ পর্যন্ত) ৮৫৭ ও ২ জন।

 

আর ২০২২ সালের জানুয়ারিতে ১২৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ২০ জন, মার্চে ২০ জন, এপ্রিলে ২৩ জন, মে মাসে ১৬৩ জন, জুনে ৭৩৭ জন, জুলাইয়ে ১,৫৭১ জন, আগস্টে ৩,৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে ৯,৯১১ জন, অক্টোবরে ২১ হাজার ৯৩২ জন, নভেম্বরে ১৯ হাজার ৩৩৪ জন এবং ডিসেম্বরে ৫ হাজার ২৪ জন ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর ওই বছর পহেলা জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন মোট ২৮০ জন। তাদের মধ্যে জুনে ১ জন, জুলাইয়ে ৭ জন, আগস্টে ১১ জন, সেপ্টেম্বরে ৩৪ জন, অক্টোবরে ৮৬ জন, নভেম্বরে ১১৩ জন এবং ডিসেম্বরে মারা গেছেন ২৭ জন।

 

এভাবে আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জানুয়ারিতে ৩২ জন, ফেব্রুয়ারিতে ৯ জন, মার্চে ১৩ জন, এপ্রিলে ৩ জন, মেতে ৪৩ জন, জুনে ২৭২ জন। ওই বছর জুলাইয়ে প্রথম ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু ঘটে। এভাবে ২০২১ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছে যথাক্রমে জুলাইয়ে ২ হাজার ২৮২ জন ও ১২ জন, আগস্টে ৭ হাজার ৬৯৬ জন ও ৩৪ জন, সেপ্টেম্বরে ৭ হাজার ৮৪১ জন ও ২৩ জন, অক্টোবরে ৫ হাজার ৪৫৮ জন ও ২২ , নভেম্বরে ৩ হাজার ৫৬৭ জন ও ৭ জন এবং ডিসেম্বরে ১ হাজার ২০৭ জন ও ৭ জন।

 

এভাবে আর ২০১৯ সালে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন জানুয়ারিতে ৩৮ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৮ জন, মার্চে ১৭ জন। ওই বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এপ্রিলে। এভাবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যু হয়েছেন যথাক্রমে এপ্রিলে ৫৮ জন ও ২ জন, মে মাসে আক্রান্ত ১৯৩ জন, জুনে ১৮৮৪ জন ও ৬ জন, জুলাইয়ে ১৬ হাজার ২৫৩ ও ৩৫ জন, আগস্টে ৫২ হাজার ৬৩৬ জন ও ৮৩ জন, সেপ্টেম্বরে ১৬ হাজার ৮৫৬ জন ও ২৫ জন, অক্টোবরে ৮ হাজার ১৪৩ জন ও ১১, নভেম্বরে ৪ হাজার ১১ জন ও ২ জন এবং ডিসেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ২৪৭। তবে বেসরকারি পরিসংখ্যানে প্রকৃত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

গতকাল সোমবার সচিবালয়ে কোভিড টিকা এবং ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা এবার ৫ গুণ। ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় যথেষ্ট ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। হাসপাতাল যাতে প্রস্তুত থাকে, চিকিৎসক এবং নার্সদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। হাসপাতালে করোনা এবং ডেঙ্গুর জন্য আলাদা ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে আড়াই হাজার নার্স-ডাক্তারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।

 

তিনি জানান, ডেঙ্গু সচেতনতায় শিক্ষক, শিক্ষার্থী, মসজিদের ইমাম এবং সেনাবাহিনীর সহায়তা নেয়া হয়েছে। প্রচার-প্রচারণার জন্য ব্যানার-পোস্টার তৈরি করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে সভা করা হয়েছে। যদি কোনো জরুরি ব্যবস্থা নিতে হয়, তার জন্য প্রস্তুতি রয়েছে বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

 

গতকাল সোমবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো ডেঙ্গু বিষয়ক দৈনিক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ৭২ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে ২৯ মে পর্যন্ত ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন মোট ১৩ জন এবং মোট আক্রান্ত হয়েছেন ১ হাজার ৮৪৩ জন বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।

 

গত রোববার ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে এডিস মশা নিধনসহ ডেঙ্গু রোধে ১১ দফা সুপারিশ। সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, আগাম বৃষ্টির কারণে এ মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের সম্ভাবনা বেশি। ইতোমধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ১৩ জন। আক্রান্তের সংখ্যাও অন্যান্য বছরের তুলনায় বেশি। শুরুতেই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে। ডেঙ্গু পরীক্ষাসহ চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। এই গাইডলাইন অনুযায়ী সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে।

 

তিনি বলেন, বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলো ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি বাবদ সর্বোচ্চ ৫০০ টাকা নিতে পারবে। এর চেয়ে বেশি নেয়া হলে ওই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর । তবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু শনাক্তের পরীক্ষার ফি ১০০ টাকা।

 

তিনি আরো বলেন, কোনো ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসার জন্য প্লাটলেট প্রয়োজন হলে জাতীয় গাইড লাইন অনুযায়ী চিকিৎসা দিতে হবে। সপ্তাহের সাত দিনই ২৪ ঘণ্টা ল্যাব খোলা রাখতে হবে। সরকারিভাবে ২১টি সেন্টারে প্লেটলেট সরবরাহের ব্যবস্থা আছে, কোনো রোগীর প্লেটলেট প্রয়োজন হলে উল্লিখিত ২১টি সেন্টার থেকে সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করা হলো।

 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক নাজমুল ইসলাম ভোরের আকাশকে বলেন, ঢাকা মহানগরীর পর দেশে সবচেয়ে বেশি ডেঙ্গু রোগী কক্সবাজারে। রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বেড়েই চলেছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। চলতি বছরেও সহস্রাধিক ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে সেখানে।

 

নাজমুল ইসলাম বলেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় যেখানে ঘনবসতি বেশি, সেখানে মশার উপদ্রব বেশি। তবে নির্দিষ্ট করে কোন এলাকায় সবচেয়ে বেশি সেটি বলা এ মুহূর্তে কঠিন। রোগীদের তথ্য যাচাই করে তারপর বলা যাবে। আমরা পুরো ঢাকা শহরকেই বিবেচনায় নিচ্ছি। আমাদের কাজ রোগী ব্যবস্থাপনা। ডেঙ্গু কোথায় বেশি এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্ব স্থানীয় সরকারের।

 

রোগী জটিলতার ব্যাপারে অধিদপ্তরের অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মো. রোবেদ আমিন ভোরের আকাশকে বলেন, ‘ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরী গড়ে উঠছে। ঠিক ব্রাজিলের মতোই। ফলে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেই আমরা প্লাটিলেটকে সামনে আনি। অথচ এটি সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের উচিত সচেতনতায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া।

 

ডেঙ্গুরোগ বিশেষজ্ঞ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, সারা বছরই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। এ বছর জানুয়ারিতেই রেকর্ড সংখ্যক ডেঙ্গুরোগী শনাক্ত হওয়ার পাশাপাশি ডেঙ্গুরোগীর মৃত্যু ঘটেছে। বিষয়টি সতর্কবার্তা হিসেবেই নিতে হবে। ডেঙ্গুর মৌসুম এখনো শুরু হয়নি। সাধারণত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়ে থাকে। গত পাঁচ মাসের অবনতির ধারা অব্যাহত থাকলে পিক মৌসুমে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হওয়ার শঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version