-->

বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস আজ

নিয়ন্ত্রণে থাকলেও রয়ে গেছে কুষ্ঠের সংক্রমণ

নিখিল মানখিন
বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস আজ

নিখিল মানখিন: নিয়ন্ত্রণে থাকলেও দেশে রয়ে গেছে কুষ্ঠরোগের সংক্রমণ। দেশে কুষ্ঠের বিশেষায়িত সেবা খুবই অপ্রতুল। কুষ্ঠরোগীদের সেবা দেয়ার জন্য বাংলাদেশে তিনটি সরকারি কুষ্ঠ হাসপাতাল রয়েছে। কুষ্ঠবিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। এখন কিন্তু এ হাসপাতালগুলোর পূর্ণাঙ্গ সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

 

আর আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এমন অবস্থার মধ্য দিয়ে আজ রোববার পালিত হচ্ছে বিশ্ব কুষ্ঠ দিবস। অন্ততপক্ষে দেশের সব সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কুষ্ঠসেবা দেয়ার জন্য উপযোগী করা দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে কুষ্ঠ দিবসটি পালনের গুরুত্ব রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে কুষ্ঠমুক্ত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহব্বান জানিয়েছেন। কুষ্ঠ মানব ইতিহাসের সবচেয়ে প্রাচীন রোগ। মানব সভ্যতার বিকাশ ও সামাজিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে উন্নত দেশগুলোতে এ রোগের প্রাদুর্ভাব একেবারেই কমে এসেছে।

 

কিন্তু আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব এখনো রয়ে গেছে। বর্তমানে বাংলাদেশসহ ব্রাজিল, ভারত, নেপাল, মোজাম্বিক, এঙ্গোলা, কঙ্গো এবং তানজানিয়ায় কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হচ্ছে। বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের চিকিৎসা বিনামূল্যে করা হলেও এবং নিয়মিত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য রোগ হওয়া সত্তে¡ও এখনো রোগটি জনস্বাস্থ্য সমস্যারূপে রয়ে গেছে।

 

দ্য লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশের (টিএলএমআই-বি) মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রতি বছর প্রায় ৩৫০০ থেকে ৪০০০ নতুন কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তি বাংলাদেশে শনাক্ত হচ্ছে। এদের মধ্যে প্রায় ৮-১০% সময়মতো চিকিৎসার অভাবে পরে পঙ্গু হয়ে যায়।

 

টিএলএমআই-বি জানায়, কুষ্ঠ সাধারণত চিকিৎসাবিহীন সংক্রামক ধরনের রোগীর হাঁচি-কাশির মাধ্যমে ছড়ায় এবং আক্রান্ত রোগীর প্রান্তিক স্নায়ুর কার্যকারিতা নষ্ট করে। ফলে আঙুল বাঁকা হওয়া, মুখের প্যারালাইসিস, বেদনাহীন ঘা ইত্যাদি বিকলাঙ্গতা দেখা দেয় এবং রোগীর শারীরিক সমস্যার চেয়েও মানসিক ও সামাজিক সমস্যা ও বৈষম্য প্রকটরূপে দেখা দেয়। চামড়ার অবশ দাগ দিয়ে এ রোগ শুরু হয়, অনেক সময় দানা গুটিও দেখা দেয়।

 

চিকিৎসকদের মতে, কুষ্ঠরোগ একটি মৃদু সংক্রামক রোগ। দুর্বল প্রতিরোধ ক্ষমতার অধিকারী মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। দারিদ্র্য, অপুষ্টি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস, প্রচুর আলো-বাতাসের অভাব ইত্যাদি এ রোগ সংক্রমণের অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।

 

১৮৭৩ সালে নরওয়ের চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. আরমার হ্যানসেন কুষ্ঠরোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাকটেরিয়াম লেপ্রি’ আবিষ্কার করেন। এ আবিষ্কারের ফলে প্রমাণিত হয় যে, কুষ্ঠ একটি ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ, জন্মগত, বংশগত বা অভিশাপের ফল নয়। হাজার হাজার বছর ধরে কুষ্ঠ রোগ ও কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত ব্যক্তিকে অভিশপ্ত এবং অস্পৃশ্য বলে গণ্য করা হতো এবং অনেককেই দীপান্তরিত, বনবাস, গৃহচ্যুত করা হতো।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, সামাজিক ও পারিবারিক সম্পর্কগুলো শিথিল হয়ে যেত। হাজার হাজার কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত মানুষ মানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হতো। হাজার বছরের অন্ধ বিশ্বাস আর কুসংস্কার মানুষের মনে এমনভাবে গেঁথে আছে যে, অনেক রোগী সামাজিকতার ভয়ে যথাসময়ে চিকিৎসা নিতে দেরি করে এবং ভয়াবহতা ডেকে আনে।

 

বিকলাঙ্গতাই হচ্ছে কুষ্ঠজনিত সব সামাজিক ও শারীরিক সমস্যার প্রধান কারণ। তাই প্রাথমিক লক্ষণ দেখা দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসায় আসা অতীব জরুরি প্রতিটি আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য। কুষ্ঠ রোগ প্রাথমিকভাবে পর্যায়ে চিহ্নিত হলে ও চিকিৎসার আওতায় এলে কুষ্ঠজনিত প্রতিবন্ধিতা প্রতিরোধ করা সম্ভব। ব্যাপক সচেতনতা কার্যক্রম এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

 

বাংলাদেশে কুষ্ঠ নির্মূলের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সমস্যা রয়েছে। কম গুরুত্ব দেয়ার কারণে এ খাতে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম, বাজেট স্বল্পতার কারণে কুষ্ঠবিরোধী কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে রোগী খুঁজে বের করার জন্য প্রশিক্ষিত লোকবলের অভাব, এ রোগকে ঘিরে কুসংস্কার দূরীকরণের জন্য প্রয়োজনীয় সচেতনতামূলক কার্যক্রমের অভাব আছে। চিকিৎসকদের কুষ্ঠ বিষয়ে ধারণা কম থাকায় রোগী চিহ্নিত করা ও চিকিৎসা কাজ ব্যাহত হয়, দেশের সর্বত্র চিকিৎসা সুবিধা সমানভাবে প্রাপ্তিসাধ্য নয় এবং দেশে কুষ্ঠের কারণে বিকলাঙ্গদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা সুবিধার অভাব রয়েছে।

 

বাংলাদেশে কুষ্ঠ রোগের সেবা : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, বাংলাদেশে কুষ্ঠরোগের ওষুধ বিনামূল্যে দেয়া হয়। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজন করে টিএলসিএ (টিবি অ্যান্ড লেপ্রসি কনট্রোল অ্যাসিস্ট্যান্ট) আছেন। যিনি মূলত মাঠপর্যায়ের সরকারি কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের সঙ্গে সরাসরি জড়িত। একজন ডাক্তার কোনো মানুষের শরীরে কুষ্ঠ আছে বলে নিশ্চিত করলে টিএলসিএ তার নিবন্ধন সম্পন্ন করেন ও এমডিটি চিকিৎসা দেয়া শুরু করেন। বাংলাদেশে জাতীয় কুষ্ঠ কর্মসূচির আওতায় কুষ্ঠরোগের সব সরকারি সেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

 

সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি এবং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বেসরকারিভাবে দি লেপ্রসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিএলএমআই-বি), ডেমিয়েন ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, লেপ্রা, হিড বাংলাদেশ, ল্যাম্ব, চন্দ্রঘোনা খ্রিস্টান হাসপাতাল, ধানজুড়ী কুষ্ঠ কেন্দ্র, দিনাজপুর, আরডিআরএস বাংলাদেশ এবং সালভেশন আর্মি বাংলাদেশে অত্যন্ত ফলপ্রসূভাবে কুষ্ঠ রোগীদের সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।

 

কুষ্ঠ রোগীদের সকল প্রকার চিকিৎসায় তথা কুষ্ঠজনিত জটিলতার চিকিৎসায় নীলফামারীতে টিএলএমআই-বির বিশেষায়িত হাসপাতাল বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আন্তর্জাতিক মানের সেবা নিশ্চিতকরণে দি লেপ্রোসি মিশন ইন্টারন্যাশনাল-বাংলাদেশ পরিচালিত এই হাসপাতালের চিকিৎসক ও সেবিকারা নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।

 

দেশে কুষ্ঠ রোগের চিত্র : বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে কুষ্ঠ আক্রান্ত রোগীর হার প্রতি ১০ হাজার মানুষের মধ্যে একজনের নিচে নামিয়ে আনা। ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করেছে। তারপরও ২০১৯ সালে সারা দেশে ৩,৬৩৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন। ২০১৮ সালে নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছেন ৩,৭২৯ জন এবং ২০১৭ সালে ৩,৭৫৪ জন।

 

সর্বশেষ করোনা মহামারির মধ্যেও ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে নতুন ৮৯৮ রোগী শনাক্ত হয়েছেন। জাতীয় কুষ্ঠ প্রকল্পের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে এখনো প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪০০০ মানুষ নতুন করে কুষ্ঠ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সাবেক মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এম এ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত সমাজে কুসংস্কার ও বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন। এর ফলে তাদের রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা, আরোগ্য লাভ এবং সামাজিক কার্যাবলি ব্যাহত হয়। রোগী শনাক্তকরণের জন্য মাঠপর্যায়ে প্রয়োজনীয় কর্মচারী নেই।

 

আমাদের মেডিকেল কলেজগুলোতে কুষ্ঠরোগ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পাঠদান করা হয় না বলে জানা যায়। বাজেট স্বল্পতার জন্য স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটানো যাচ্ছে না। অ্যাডভোকেসি কার্যক্রম চালানো দরকার, এতে ব্যাপক অর্থের প্রয়োজন। এই রোগ এককভাবে নির্মূল করা সম্ভব নয়। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব প্রয়োজন।

 

সাবেক স্বাচিপ মহাসচিব আরো বলেন, কুষ্ঠবিষয়ক প্রায় ৮০ ভাগ স্বাস্থ্যসেবা এনজিও কর্তৃক পরিচালিত হাসপাতালগুলো দিয়ে থাকে। কিন্তু আর্থিক সমস্যার কারণে তাদের এ সেবা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে সরকার এগিয়ে না এলে সমস্যা বাড়বে, প্রতিবন্ধিতা আরো বেড়ে যাবে। দেশে কুষ্ঠজনিত সব প্রতিবন্ধী লোকজনের সঠিকভাবে সামাজিক পুনর্বাসনের প্রয়োজন, যেন তারা সমাজে মর্যাদার সঙ্গে বাস করতে পারে। উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের প্রতিবন্ধিতা কমিয়ে কর্মক্ষম করে তোলা সম্ভব।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version