-->
ডা. ফাতেমার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগ

কমিটি হয়, শেষ হয় না তদন্ত

এম বদি-উজ-জামান
কমিটি হয়, শেষ হয় না তদন্ত

এম বদি-উজ-জামান: জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফাতেমা দোজা। ছিলেন মেডিকেল অফিসার। পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক। কিন্তু তাকে নিয়ে বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না। তার বিরুদ্ধে অভিযোগের শেষ নেই। তবে ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই তদন্তে নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু ওই তদন্ত আর শেষ হয় না।

 

এগারো বছর আগে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার পরও তিনি বহাল তবিয়তেই আছেন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের (এনআইসিভিডি) রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে। এমনকি তিনি মেডিকেল অফিসার থেকে পদোন্নতি পেয়ে হয়েছেন সহযোগী অধ্যাপক। তথ্য গোপন করে এই পদোন্নতি নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর এক বছর আগে তার তদন্তে নামে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেই তদন্ত আজো শেষ হয়নি। কবে শেষ হবে, তা কেউ বলতে পারেন না। খোদ তদন্ত কমিটির প্রধান স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব (সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অধিশাখা) মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিনের কাছেও এর জবাব নেই।

 

এই তদন্ত চলাকালেই ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, তিনি প্রতারণা করে আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ অভিযোগেরও তদন্তে নেমেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে তদন্ত করছেন উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।

 

জানা যায়, তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত কমিটি দীর্ঘদিন ধরে দফায় দফায় চিঠি দিয়েছে অভিযোগ বিষয়ে ডা. ফাতেমা দোজার বক্তব্য জানার জন্য। তদন্ত কমিটির প্রধান বদল হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘদিন জবাব না দিয়ে বারবার সময় ক্ষেপণ করেছেন তিনি। জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত জবাব দাখিল করেছেন। এই জবাবের পর তদন্ত কমিটি হিসাব মহানিয়ন্ত্রক (সিজিএ)সহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছে ফাতেমা দোজার বিষয়ে। তদন্ত কমিটির প্রধান মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ভোরের আকাশকে বলেন, ফাতেজা দোজার জবাব পেয়েছি। এরপর বিভিন্ন দপ্তরে চিঠি দিয়েছি তার বিষয়ে তথ্য জানতে। সেটা আসার পরই বলা যাবে তদন্ত কোন পর্যায়ে আছে।

 

তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেয়ার অভিযোগ : জানা যায়, সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার পরও চাকরিতে বহাল থাকা ও তথ্য গোপন করে পদোন্নতি নেয়ার বিষয়ে ডা. ফাতেমা দোজার বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১২ ডিসেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দাখিল করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) একজন চিকিৎসক। তার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য বিভাগের যুগ্মসচিব (প্রবা-১ অধিশাখায় সংযুক্ত) মিনা মাসুদ উজ্জামানকে তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দিয়ে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আদেশ জারি করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

 

ওই আদেশে অভিযোগ তদন্ত করে ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয় তদন্ত কর্মকর্তাকে। এরপর স্বপক্ষে থাকা কাগজপত্রসহ লিখিত জবাব দিতে ডা. ফাতেমা দোজাকে চিঠি দেন তদন্ত কর্মকর্তা। চিঠি পেয়ে ডা. ফাতেমা দোজা গত বছর ১০ জানুয়ারি তদন্ত কর্মকর্তার সামনে স্বশরীরে হাজির হয়ে সময় নেন। তদন্ত কর্মকর্তা তাকে গত বছর ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে জবাব না দেয়ায় তাকে ওই বছরের ২৩ জানুয়ারির মধ্যে জবাব দাখিল করতে আবারো চিঠি দেন তদন্ত কর্মকর্তা।

 

ওই তারিখেও ডা. ফাতেমা দোজা উপস্থিত হননি এবং লিখিত জবাবও দাখিল করেননি। এ অবস্থায় মিনা মাসুদ উজ্জামানকে অন্যত্র বদলি করা হয়। এ কারণে তিনি ফাতেমা দোজার নথি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়ে দেন। তাতে বলা হয়, কাগজপত্র দাখিল না করায় তিনি তদন্ত সম্পন্ন করতে পারেননি।

 

পরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্মসচিব (বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা) মোহাম্মদ হেলাল হোসেনকে নতুন তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পাশাপাশি ডা. ফাতেমা দোজাকে প্রমাণাদিসহ তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হতে গত বছর ২৯ মার্চ চিঠি দেন উপসচিব উম্মে হাবিব। ওই চিঠিতে ডা. ফাতেমা দোজাকে প্রমাণাদিসহ গত বছর ৫ এপ্রিল তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হতে বলা হয়। জানা যায়, এরপর এই তদন্ত কর্মকর্তার সামনে হাজির হয়ে ডা. ফাতেমা দোজা দুই সপ্তাহ সময় নন। তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হেলাল হোসেন জানান, তাকে গত বছর ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দেন। ওই সময়েও ডা. ফাতেমা দোজা জবাব দাখিল না করে আরো কয়েক দফা সময় নেন।

 

নথিপত্রে দেখা যায়, ডা. ফাতেমা দোজা বিএসএমএমইউতে সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগ পান ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। সম্পূর্ণ অস্থায়ী ভিত্তিতে ছয় মাসের জন্য তাকে নিয়োগ দেয়া হয়। বিএসএমএমইউর তখনকার রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত) অধ্যাপক মো. শফিকুল ইসলামের স্বাক্ষরে দেয়া ওই নিয়োগপত্রে ১৫ দিনের মধ্যে তাকে যোগদান করতে বলা হয়। এই নিয়োগপত্র পাওয়ার দুদিন পর ওই বছরের ২২ ফেব্রুয়ারি ডা. ফাতেমা দোজা হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের মেডিকেল অফিসার পদ থেকে অব্যাহতি চেয়ে স্বাস্থ্য সচিবের কাছে আবেদন করেন।

 

ডা. ফাতেমা দোজার অব্যাহতি চেয়ে আবেদনের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে পরদিন ২৩ ফেব্রæয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে চিঠি দেন হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ আল সাফী মজুমদার। এরপর ডা. ফাতেমা দোজা বিএসএমএমইউতে রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তিনি সেখানে নির্ধারিত ছয় মাস চাকরি করেন। নির্ধারিত ছয় মাস পর ডা. ফাতেমা দোজার চাকরি স্থায়ী করেনি বিএসএমএমইউ।

 

এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডা. ফাতেমা দোজাকে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি দিয়ে ২০১৩ সালের ১০ জুন প্রজ্ঞাপন জারি করে। একইসঙ্গে তাকে জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের এই প্রজ্ঞাপন দেখে আশ্চর্য হন বিএসএমএমইউর চিকিৎসকরা। এরপরও ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকে পরদিন ১১ জুন জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক পদে (শূন্য পদ) যোগদান করেন। পরে তাকে ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। এ অবস্থায় গত বছর ২ আগস্ট তাকে অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতির প্রস্তাব পাঠানো হয় সুপরিয়র সিলেকশন বোর্ডে (এসএসবি)।

 

অভিযোগ রয়েছে, এসব কিছুই হয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের একশ্রেণির কর্মকর্তাকে হাত করেই। সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি নেয়ার পরও একই ব্যক্তিকে বারবার পদোন্নতি দেয়ার ঘটনায় বিস্ময় সৃষ্টি হয়েছে। বিষয়টি লিখিতভাবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নজরে এনেছেন বিএসএমএমইউর একজন চিকিৎসক। এর পরই নড়েচড়ে বসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।

 

জানা যায়, ডা. ফাতেমা দোজা ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে ১৯৯৬ সালে এমবিবিএস পাস করেন। এরপর ১৮তম বিসিএস (স্বাস্থ্য) ক্যাডারের একজন কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৯৯ সালে জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। এরপর ২০০২ সালে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মেডিকেল অফিসার হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। ২০০৭ সালে তাকে বদলি করা হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। সেই থেকে তিনি সেখানে কর্মরত।

 

প্রতারণা করে আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা : গত বছর ২৭ নভেম্বর থেকে ৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগোতে রেডিওলজি সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকার (আরএসএনএ) ১০৮তম বার্ষিক সভা ও বৈজ্ঞানিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ওই সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে আমন্ত্রণ পান জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমেজিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফাতেমা দোজা। ওই আমন্ত্রণপত্রে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসের রেডিওলজি অ্যান্ড ইমাজিং ফ্যাকালটির সদস্য সচিব এবং রেডিওলজি অ্যান্ড ইমাজিং সোসাইটির আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক ডা. ফাতেমা দোজার আমেরিকা যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় খরচ নিজের বহন করার কথা বলা হয়।

 

কিন্তু ওই আমন্ত্রণপত্র পাওয়ার পর তিনি বিদেশে যাওয়ার অনুমতির জন্য নিজ বিভাগে তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। ওই আবেদনের সঙ্গে দাখিল করা আরএসএনএর দেয়া আমন্ত্রণপত্রে কারচুপির আশ্রয় নেন ডা. ফাতেমা। আমন্ত্রণপত্র পরিবর্তন করে দাখিল করেন। পরিবর্তিত আমন্ত্রণপত্রে দেখানো হয়, আমেরিকা যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়াসহ যাবতীয় খরচ বহন করবে আরএসএনএ। এই আমন্ত্রণপত্র সন্দেহজনক হলে তা খতিয়ে দেখতে আমেরিকায় যোগাযোগ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এর পরই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসে। আরএসএনএ থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ই-মেইলের মাধ্যমে চিঠি দিয়ে সঠিক তথ্য জানিয়েছে।

 

এটা জানার পরই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আমন্ত্রণপত্র পরিবর্তন/জালিয়াতি করে দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করায় তদন্তের সিদ্ধান্ত নেয়। তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেনকে। এর পর গত ১৫ ডিসেম্বর কারণ দর্শাতে ডা. ফাতেমা দোজাকে চিঠি দেন মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন।

 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান উপসচিব মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন ভোরের আকাশকে বলেন, অভিযোগের বিষয়ে জানতে ডা. ফাতেমা দোজাকে চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠির জবাব দাখিল করেননি ফাতেমা দোজা। তাই তাকে কারণ দর্শাতে আবার চিঠি দেয়া হবে।

 

অভিযোগ রয়েছে, অভিজ্ঞ এবং সিনিয়রদের বাদ দিয়ে ডা. ফাতেমা দোজা বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিসিয়ানস অ্যান্ড সার্জনসে (বিসিপিএস) এফসিপিএস এবং এমসিপিএস রেডিওলজি ও ইমেজিং কোর্সের পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, বাছাই, লিখিত পরীক্ষার খাতা নিরীক্ষণ করা এবং মৌখিক পরীক্ষা গ্রহণের কাজ করেন। ডা. ফাতেমা দোজা কর্তৃক রেডিওলজি কোর্সের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পরীক্ষা সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ করার কারণে পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী চিকিৎসক এবং বিসিপিএসে কর্মরতদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version