-->
দাম বাড়ানোর চাপ রয়েছে : অধিদপ্তর

ঘন ঘন ওষুধের দাম বৃদ্ধি, অস্বস্তিতে চিকিৎসা সেক্টর

ক্রয়ক্ষমতা হারাচ্ছেন অনেক রোগী

নিখিল মানখিন
ঘন ঘন ওষুধের দাম বৃদ্ধি, অস্বস্তিতে চিকিৎসা সেক্টর

নিখিল মানখিন: ঘন ঘন ওষুধের দাম বৃদ্ধিতে অস্বস্তিতে পড়ছে দেশের চিকিৎসা সেক্টর। ওষুধ কেনার সামর্থ্য হারাচ্ছেন অনেকে। ওষুধের দাম আরেক দফা বৃদ্ধির চাপ রয়েছে বলে জানিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চিকিৎসাসেবার উচ্চব্যয় বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব হওয়া পরিবারের সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। ওষুধ গ্রহণ ছাড়া পূর্ণ চিকিৎসাসেবা সম্ভব নয়। অনেক রোগীকে দীর্ঘমেয়াদি বা আজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। অর্থের অভাবে নিয়মিত ওষুধ খেতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঘটনাও ঘটছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

 

ওষুধের দাম বাড়াতে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চাপ রয়েছে বলে গত বুধবার জানিয়েছেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ। তিনি বলেন, করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে। ফলে কাঁচামাল আনতে সমস্যা হচ্ছে, যার কারণে ওষুধের দাম বাড়াতে আমাদের ওপর চাপ রয়েছে। এ জন্য চিকিৎসকদের এগিয়ে আসতে হবে।

 

এদিকে, ২০২২ সালের জুলাইয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় বহুল ব্যবহৃত ২০টি জেনেরিকের ৫৩টি ব্র্যান্ডের ওষুধের দাম বাড়িয়েছিল সরকার। এর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার প্যারাসিটামলের দাম বাড়ানো হয়েছে ৫০ থেকে শতভাগ। মাত্র ৪০ টাকার এমোক্সিসিলিনের দাম করা হয়েছে ৭০ টাকা, ২৪ টাকার ইনজেকশন ৫৫ টাকা। ৯ টাকার নাকের ড্রপের দাম বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৮ টাকা। কোনো কোনো ওষুধের দাম ৯৯ থেকে ১৩২ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এর আগে ২০১৫ সালে কয়েকটি কম্বিনেশনের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।

 

ঘন ঘন দাম বাড়ানো অযৌক্তক : ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, দেশের ৯৮ ভাগ ওষুধ আমরা তৈরি করি। ২ ভাগ ওষুধ বাইরে থেকে আনতে হয়। তাই সমস্যা হওয়ার কথা নয়। চাপ সামাল দিতে সরকারের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা হচ্ছে। একই সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় বিভিন্ন কোম্পানি থেকে চিকিৎসকদের নেয়া বিভিন্ন উপহার কমিয়ে দিতে হবে বলে মন্তব্য করেন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ ।

 

কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন সাংবাদিকদের, গত দুই-তিন বছরে মানুষের আয় বাড়েনি। এ অবস্থায় ওষুধ কোম্পানিগুলোর ‘অতি লোভের’ কারণে দাম বাড়ানো হচ্ছে ভোক্তার অধিকার উপেক্ষা করে। জীবনমান নিম্ন মুখী, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ওষুধ কেনার সামর্থ্য অনেকে হারাচ্ছেন। অতি মুনাফা করার যে লোভ তা মূল্যস্ফীতিকে আরো চাঙ্গা করে দিয়েছে। গত ছয় মাসে অনেক ওষুধের দাম ১৩ থেকে ৭৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এছাড়া গ্যাস্ট্রিকের ওষুধ, অ্যান্টিবায়োটিক উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন রোগের ওষুধের দাম বেড়েছে ১৩ থেকে ৩৩ শতাংশ পর্যন্ত।

 

গোলাম রহমান আরো বলেন, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ‘যুক্তিসঙ্গতভাবে’ ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করবে, এটাই তারা প্রত্যাশা করেন। সরকারি সংস্থা হিসেবে ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখবে। তারা যখন ব্যর্থ হয়, তখন আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ি। তারা যেন যুক্তিসঙ্গতভাবে ওষুধের মূল্য নির্ধারণ করেন এবং ওষুধ যেন মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, দেশে সব নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। গত জুনে ওষুধের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। ফলে ওষুধের এই বাড়তি দাম রোগীর ওপরে চাপ আরো বাড়াবে। সরকার চাইলে অন্য কোনো উপায়ে ওষুধ কোম্পানিগুলো সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে পারত। তবে এ সময়ে ওষুধের মূল্য বৃদ্ধি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হবে।

 

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, সবকিছুর দামই বাড়ে। ওষুধের দামও বাড়তে পারে, তবে লাগামহীনভাবে নয়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মধ্যে ওষুধ অন্যতম। অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে ওষুধের দামও বেড়ে গেছে। ওষুধ প্রস্তুতের কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। বিশ্বব্যাপী সবকিছুর দাম বেড়েছে। কিন্তু এ সুযোগে লাগামহীন দাম বাড়ালে জনগণের ওপর বাড়তি চাপ পড়বে। ওষুধ গ্রহণ ছাড়া পূর্ণ চিকিৎসাসেবা সম্ভব নয়। অনেক রোগীকে আজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। তাই দরিদ্র রোগীদের বিষয়টি মাথায় রেখে দাম বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আ ব ম ফারুক ভোরের আকাশকে বলেন, বাস্তবতার চাহিদা অনুযায়ী দাম বাড়ালে বলার কিছু থাকে না। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে দেশে এক আজব নিয়ম বিদ্যমান রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী, অত্যাবশ্যকীয় ওষুধের তালিকা করা ছাড়াও ওষুধগুলোর দাম নির্ধারণ করে সরকার। আমাদের দেশের ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতিতেও তা ছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালে ওষুধ কোম্পানির দাবির মুখে বলা হলো, ১৭ শতাংশ ওষুধের দাম সরকার নির্ধারণ করবে, বাকিটা করবে কোম্পানি।

 

দেশের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের তথ্যমতে, চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে গিয়ে প্রতিবছর দেশে ৮৬ লাখ মানুষ আর্থিক সমস্যায় পড়ে। ব্যয় বেশি হওয়ার কারণে ১৬ শতাংশ মানুষ স্বাস্থ্যসেবা নেয়া থেকে বিরত থাকে। দেশে একজন মানুষের মোট চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ ওষুধ বাবদ খরচ হয় এবং এই খরচ করতে হয় রোগীর পকেট থেকেই। হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধেই মানুষের সবচেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে। অন্যান্য দেশে সরকার এ ব্যয়ের একটি বড় অংশ বহন করে তবে বাংলাদেশে এখনো এটি করা সম্ভব হয়নি।

 

বিশেজ্ঞরা বলছেন, ওষুধ রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ওষুধ রপ্তানি আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। ফলে পৃথিবীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে এ দেশ। আমেরিকা, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের ১৫১টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে বাংলাদেশ। দেশের ৯৮ শতাংশ ওষুধের চাহিদা মিটিয়ে এসব দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এটা দেশের জন্য ইতিবাচক দিক। এই ইতিবাচক সংবাদের মধ্যে দুঃখজনক সংবাদ হচ্ছে, ঘন ঘন ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি দেশের চিকিৎসাসেবা চরমভাবে ব্যাহত করছে। অনেক রোগীকে আজীবন ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। অর্থের অভাবে নিয়মিত ওষুধ খেতে না পেরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ার ঘটনাও ঘটছে। নিয়মিত বাজার তদারকির ব্যবস্থা না থাকলে ওষুধের দাম আরো বৃদ্ধি পাবে। ফলে সাধারণ মানুষ ওষুধ কেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলবে।

 

ভোরের আকাশ/নি 

 

মন্তব্য

Beta version