-->

পেশা বদলাচ্ছেন পল্লি চিকিৎসকরা

নিখিল মানখিন
পেশা বদলাচ্ছেন পল্লি চিকিৎসকরা

নিখিল মানখিন: পল্লি চিকিৎসকদের কাজে লাগাচ্ছে না সরকার। তাদের উন্নয়নে নেই সরকারি পরিকল্পনা। অবহেলার শিকার হয়ে অনেক পল্লি চিকিৎসক নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। এমন অভিযোগ করেছেন পল্লি চিকিৎসকরা।

 

তারা বলেন, দেশে চিকিৎসকের সংকট রয়েছে। এ অবস্থায় দেশের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবায় কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের পাশাপাশি পল্লি চিকিৎসকদের কাজে লাগানো যেতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন পল্লি চিকিৎসকরা। সরকারি সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলে পল্লি চিকিৎসকরা ভুল ও অবৈধ চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন না।

 

সরেজমিন দেখা গেছে, পল্লি চিকিৎসকরা নানাভাবে অবহেলার শিকার হচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলে তাদের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচারণা চালু রয়েছে। ময়মনসিংহের ধোবাউড়া থানায় ছোট্ট চেম্বারে ওষুধ সাজিয়ে বসে আছেন পল্লি চিকিৎসক হোসেন আলী।

 

তিনি ভোরের আকাশকে জানান, পুরো ধোবাউড়া থানায় প্রায় ২০০ পল্লি চিকিৎসক ছিলেন। কয়েক বছর আগের ঘটনা। পল্লি চিকিৎসকদের সরকারি ও বেসরকারিভাবে মূল্যায়ন করা হয় না। অবহেলার শিকার হয়ে অনেক পল্লি চিকিৎসক নিজ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন।

 

অথচ এখন পর্যন্ত অনেক দরিদ্র রোগী পল্লি চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হন। অভিজ্ঞতার বাইরের রোগীকে চিকিৎসাসেবা দিই না আমরা। সামর্থ্যরে বাইরে চলে গেলে সঙ্গে সঙ্গে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রেফার করে থাকি। থানা সদর থেকে দূরের এলাকাগুলোয় তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসার ক্ষেত্রে পল্লি চিকিৎসকের বিকল্প এখনো সরকার তৈরি করতে পারেনি বলে দাবি করেন হোসেন আলী। পল্লি চিকিৎসক ছেড়ে কাপড়ের ব্যবসায় নেমে পড়েছেন একই এলাকার মো. রুস্তম।

 

তিনি ভোরের আকাশকে জানান, অনেক আশা করে পল্লি চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ নিয়েছিলাম। বাজারে গড়ে তুলেছিলাম ছোট্ট একটি ওষুধের দোকান। দোকানের ভেতরেই ছিল রোগী দেখার কক্ষ। প্রাথমিক চিকিৎসা দেখার সব প্রশিক্ষণ পেয়েছি। কিছু ওষুধ বিক্রি হলেও প্রত্যাশিতসংখ্যক রোগী পাওয়া যায়নি। পল্লি চিকিৎসকদের প্রতি সাধারণ মানুষের পুরোপুরি আস্থা গড়ে ওঠেনি। নিজের সীমিত পুঁজি দিয়ে বেশিদিন টিকে থাকতে পারিনি। বাধ্য হয়ে অন্য ব্যবসায় চলে গেলাম বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মো. রুস্তম।

 

শুধু হোসেন আলী, মো. রুস্তম নন, প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশের সব পল্লি চিকিৎসক হতাশায় দিন কাটাচ্ছেন। ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট থানাধীন ভুবনকুড়া গ্রামের মো. সাত্তার। তিনি সরকার অনুমোদিত প্রশিক্ষণ নিয়ে পল্লি চিকিৎসক হিসেবে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদানের অনুমতি পেয়েছেন ২৫ বছর আগে। কিন্তু এ পেশা ছেড়ে দেয়ার ৭ বছর পার হয়ে গেছে।

 

এর কারণ হিসেবে তিনি ভোরর আকাশকে জানান, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে গ্রামাঞ্চলে আমাদের গুরুত্ব অনেক আগেই কমে গেছে। তেমন রোগী আসে না। সবাই যেন অবহেলার চোখে দেখেন। সরকারিভাবে আমাদের ভালোভাবে উপস্থাপন করা হলে আমরা সাধারণ মানুষের কাছে মূল্যায়িত হতাম। কিন্তু দিন দিন অবহেলিত হয়েই যাচ্ছি।

 

বাংলাদেশ পল্লি চিকিৎসক সমিতির সভাপতি ডা. মো. সবুজ আলী ভোরের আকাশকে বলেন, পল্লি চিকিৎসকের প্রশিক্ষণ গ্রহণ ও চিকিৎসাসেবা প্রদানের বিষয়টি সরকারিভাবে স্বীকৃত। নির্ধারিত রোগ ও ওষুধের ওপর প্রেসক্রিপশন দিতে পারেন তারা। ভুয়া ডাক্তার থাকতে পারেন, কিন্তু পল্লি চিকিৎসকরা ভুয়া হতে পারেন না।

 

সীমিত পরিসরে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা দেয়ার কারণে পল্লি চিকিৎসকদের ভুয়া সাজার সুযোগ থাকে না। তারা জটিল রোগের চিকিৎসা করেন না। গ্রামীণ জনপদে পল্লি চিকিৎসকেরা নামমাত্র ফি নিয়ে চিকিৎসাসেবা দিয়ে থাকেন।

 

ডা. সবুজ আলী আরো জানান, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের ২০১০ সালের ৬১নং আইনের ১৫(১), ২২ (১) ও ২৯ (১) ধারা উপধারাসহ বিভিন্ন জনবিরোধী পাসকৃত আইনটি সংশোধন, সংযোজন ও বিয়োজন করা দরকার। পল্লিবাসীদের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য পরিচর্যা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে সিভিল সার্জনের অধীন আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক বছর মেয়াদি পল্লি চিকিৎসক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করে।

 

কিন্তু একশ্রেণির ষড়যন্ত্র-চক্রান্তকারীদের কারণে পল্লি চিকিৎকদের নামের আগে ডাক্তার পদবি ব্যবহার ও নিবন্ধন ছাড়া চিকিৎসা করতে পারবে না এ মর্মে আইন পাস হয়। এতে হাজার হাজার ডিপ্লোমাধারী পল্লি চিকিৎসক চিকিৎসাসেবা প্রদান থেকে বঞ্চিত হয়েছে। গ্রামের সাধারণ মানুষ স্বল্প খরচে পল্লি চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে পারেন। জটিল রোগে আক্রান্ত হলে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের জন্য রোগীদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন পল্লি চিকিৎসকরা।

 

তিনি আরো জানান, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতির খসড়া জাতীয় সংসদে অনুমোদিত হয়েছে। নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক স্বাস্থ্য, পরিবার পরিকল্পনা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সেবা প্রদানের লক্ষ্যে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক পুরোপুরি চালু করা প্রয়োজন। কারণ দেশের গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী ৮৫ শতাংশ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পল্লি চিকিৎসক ও কমিউনিটি ক্লিনিকের ভ‚মিকা ব্যাপক।

 

পল্লি চিকিৎসকদের কাজে লাগানোর জন্য সরকারের প্রতি আহব্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ পল্লি চিকিৎসক সমিতির সভাপতি ডা. মো. সবুজ আলী।

 

চিকিৎসক নেতারা বলেন, বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৮৫ শতাংশ মানুষ গ্রামাঞ্চলে বসবাস করে। এই গ্রামাঞ্চলে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার নেই বললেই চলে। ফলে গ্রাম পর্যায়ের বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীকে স্বাস্থ্যসেবার জন্য পল্লি চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হতে হয়। পল্লি চিকিৎসক বা গ্রাম ডাক্তাররা গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবায় তাৎপর্যপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করছেন।

 

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ বাড়ির দোরগোড়ায় অত্যাবশ্যকীয় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পল্লি চিকিৎসকদের মাধ্যমে পেয়ে থাকেন। গ্রামের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য বিষয়ক সচেতনতা বাড়াতে পল্লি চিকিৎসকগণ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারেন। স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমেও পল্লি চিকিৎসকরা স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

 

প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা, শিশু ও মায়ের স্বাস্থ্যসেবা, টিকাদান, পরিবার পরিকল্পনা, সংক্রমক রোগ প্রতিরোধ, য²া রোগ শনাক্তকরণ ও চিকিৎসা, অপুষ্টিজনিত রোগের চিকিৎসা, যৌনবাহিত রোগের চিকিৎসা, এইচআইভি/এইডস শনাক্তকরণ, সব ধরনের সাধারণ রোগের চিকিৎসা প্রভৃতি ক্ষেত্রে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে পল্লি চিকিৎসকগণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন।

 

আমাদের দেশে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব রয়েছে, সেক্ষেত্রে বিশেষ করে গ্রাম পর্যায়ের চিকিৎসা ব্যবস্থায় পল্লি চিকিৎসকদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব অনস্বীকার্য। দ্রæততম সময়ের মধ্যে তৃণমূল জনগণের কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছাতে পল্লি চিকিৎসকরা ভ‚মিকা রাখতে পারেন। পল্লি চিকিৎসকদের ন্যূনতম এসএসসি পাস ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদনসাপেক্ষে চিকিৎসা কার্যক্রম চালানো উচিত। এতে পল্লি চিকিৎসকদের মর্যাদা বাড়বে এবং মানুষের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

 

উল্লেখ্য, বর্তমানে অনেক উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিরাও পল্লি চিকিৎসায় নিয়োজিত রয়েছেন, তাদেরও প্রয়োজনীয় এবং যথোপযুক্ত মানের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে পেশাগত দক্ষতা অর্জন করা আবশ্যক। চিকিৎসা পেশা অন্যান্য পেশার তুলনায় স্পর্শকাতর এবং শারীরিক ও মানসিক কষ্ট বা অসুস্থতা তথা জীবন-মৃত্যুর সমস্যার সঙ্গে জড়িত হওয়ায় ন্যূনতম শিক্ষা ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া এ পেশায় নিয়োজিত হওয়া উচিত নয়।

 

এ বিষয়ে সরকার আগ্রহী ও উপযুক্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে পল্লি চিকিৎসক তৈরির মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পারেন।

 

স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারিভাবে অনুমোদিত প্রতিষ্ঠানে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তরা সীমিত পরিসরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার অধিকার রাখেন। তবে তারা ‘ ডাক্তার’ শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন না।

 

তিনি আরো জানান, দেশের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবাদানে কমিউনিটি হেলথ প্রোভাইডারদের পাশাপাশি পল্লি চিকিৎসকদের কাজে লাগাতে যেতে পারে। প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ পেয়ে থাকেন পল্লি চিকিৎসকরা। সরকারি সহযোগিতা ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হলে পল্লি চিকিৎসকরা ভুল ও অবৈধ চিকিৎসাসেবায় সম্পৃক্ত হতে পারবেন না।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version