-->
ডেঙ্গু, করোনা ও শীতজনিত রোগ

উপসর্গ মিল থাকায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণে বিড়ম্বনা

নিখিল মানখিন
উপসর্গ মিল থাকায় তাৎক্ষণিক চিকিৎসা গ্রহণে বিড়ম্বনা

নিখিল মানখিন: দেশে শুরু হয়েছে শীতজনিত রোগের মৌসুম। উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়েছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। আর সহনীয় হলেও অব্যাহত রয়েছে করোনা সংক্রমণ। এই তিন ধরনের রোগের মধ্যে বেশকিছু উপসর্গের মিল থাকায় শঙ্কিত জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

 

তারা বলছেন, শীতজনিত রোগগুলোর দায়ভার পড়ছে করোনা ও ডেঙ্গুর ওপর। উপসর্গে মিল থাকায় পরীক্ষা করানোর আগ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন করোনা, ডেঙ্গু ও শীতজনিত রোগে আক্রান্তরা। বিড়ম্বনা ও সময়ক্ষেপণে রোগীর চিকিৎসা ব্যাহত হচ্ছে।

 

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু, করোনা ও শীতজনিত রোগের উপসর্গগুলোর মধ্যে সর্দি-কাশি, জ্বর, গলা ব্যথা, শরীর ব্যথা, উচ্চ তাপমাত্রা ও শ্বাসকষ্ট রয়েছে। দেশে করোনা প্রবেশ করার আগে প্রতি বছর শীতজনিত রোগগুলোর নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। করোনা প্রবেশ করার পর থেকে প্রতিবেদনটি বন্ধ রয়েছে।

 

সর্বশেষ ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে প্রায় ৪ লাখ আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

 

পাঁচ দিন সর্দি-কাশি ও জ্বরে ভোগার পর গত ১৩ নভেম্বর রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ডেঙ্গু ও করোনা টেস্ট করানোর জন্য নমুনা জমা দেন মো. সাইফুল। পরীক্ষার রিপোর্টে ডেঙ্গু ও করোনা ধরা পড়েনি।

 

তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সর্দি-কাশি ও জ্বরে কাহিল হয়ে গিয়েছিলাম। পাড়া-প্রতিবেশীর ঠেলাঠেলিতে পরীক্ষা করাতে বাধ্য হই। আমি নিজেও ধরে নিয়েছিলাম, আমার করোনা অথবা ডেঙ্গু পজিটিভ আসবে। কিন্তু কোনটাই ধরা পড়েনি। পরে ডাক্তার দেখিয়ে সর্দি জ্বরের চিকিৎসা নিলাম।

 

মগবাজার মোড়ের কাছে ওয়াকফ ভবনের সামনে ভাসমান চা দোকান চালান মো. আবুল হোসেন। সর্দি-জ্বরের পাশাপাশি গলায় ব্যথা ছিল তার। মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে তিনি করোনা টেস্ট করান। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, চা দোকান চালালে সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তবে ঘন ঘন হাত ধোয়া হয়। জ্বরের কারণে দুদিন দোকান বন্ধ রেখেছি। গলাব্যথা থাকায় করোনা টেস্ট করাতে গিয়েছি। রিপোর্টে করোনা নেগেটিভ এসেছে বলে জানান মো. আবুল হোসেন।

 

অন্যদিকে সর্দি-কাশি ও জ্বরের উপসর্গ নিয়ে টেস্ট করাতে গিয়ে ডেঙ্গু ও করোনা পজিটিভ হয়েছেন অনেকে। বড় মগবাজার বাটার গলিতে পরিবার নিয়ে থাকেন মো. ফরহাদ হোসেন। তিনি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে কর্মরত। সর্দি-কাশি ও জ্বর এমনিতেই চলে যাবে চিন্তা করে তিনি কয়েকদিন পার করেছেন। অবশেষে পরিবারের লোকজনের পরামর্শে তিনি করোনা টেস্ট করান। ডেঙ্গু পজিটিভ আসে রিপোর্টে।

 

এভাবে একই উপসর্গ নিয়ে পরীক্ষা করাতে যাওয়া লোকদের কেউ কেউ করোনা ও ডেঙ্গু রোগী এবং বাকিরা শীতজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটছে। এমনিতেই দেশে করোনা টেস্ট করানোর বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতা ও অনীহা দেখা দিয়েছে।

 

তার মধ্যে করোনা, ডেঙ্গু ও শীতজনিত রোগের উপসর্গের মিল থাকায় করোনা টেস্ট করাতে দ্বিধাদ্ব›েদ্ব পড়ে অনেক সময় রোগীর অবস্থার অবনতি হওয়ার ঘটনা ঘটছে।

 

দেশে করোনা প্রবেশ করার আগে প্রতি বছর শীতজনিত রোগগুলোর নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করত স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন্স সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে থাকে। সাধারণত প্রতি বছর নভেম্বর থেকে ফেব্রæয়ারি পর্যন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ চলত।

 

করোনা প্রবেশ করার পর থেকে শীতজনিত রোগের দৈনিক প্রতিবেদনটি বন্ধ রয়েছে। অধিদপ্তরের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর থেকে ২০২০ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত সারা দেশে শীতজনিত রোগগুলোর মধ্যে শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণে ৬৫ হাজার ২১৬ এবং সর্দি-কাশি ও জ্বরে ১ লাখ ৮৭ হাজার ২৭৪ জন আক্রান্ত হয়। ওই মৌসুমে শীতজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৪ লাখ ছাড়িয়ে যায়।

 

রোগতত্ত¡, রোগনির্ণয় ও রোগ গবেষণা কেন্দ্রের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেনও সাবধানে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে আতঙ্কের কিছুই নেই। চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বলে কিছু ওষুধপত্র সেবন করলে কয়েকদিনের মধ্যেই সমস্যা কেটে যাবে। তবে করোনা, ডেঙ্গু ও কিছুসংখ্যক শীতজনিত রোগের বেশকিছু উপসর্গের মিল রয়েছে। আক্রান্ত রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসার বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না। দেরি না করে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। দ্রæত করাতে হবে করোনা ও ডেঙ্গু টেস্ট। সাধারণ সর্দি-কাশি ও জ্বর ভেবে ঘরে বসে থাকা যাবে না।

 

মুশতাক হোসেন বলেন, শীতজনিত রোগগুলোর দায়ভার বর্তাচ্ছে করোনা ও ডেঙ্গুর ওপর। উপসর্গ মিল থাকায় পরীক্ষা করোনার আগ পর্যন্ত বিড়ম্বনায় পড়ছেন করোনা ও শীতজনিত রোগে আক্রান্তরা। বর্তমানে চলছে শীতজনিত রোগে মৌসুম। দেশের করোনা পরিস্থিতিরও প্রতিদিন অবনতি ঘটছে। তাই এসব বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে জানান, শীতজনিত সর্দি-কাশি ও জ্বরও ভাইরাসজনিত রোগ। শীতজনিত রোগ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।

 

এ সময় শীতজনিত রোগের প্রকোপ থাকবেই। প্রতি বছরই এমনটি হয়ে থাকে। তবে কিছুতেই ঠান্ডা লাগানো যাবে না। সাবধানতা অবলম্বন না করলে সাধারণ ব্যাধিই অনেক সময় স্থায়ী ও জটিল ব্যাধিতে রূপ নিতে পারে। বিশেষ করে হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রকোপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়।

 

করোনা ও কিছু শীতজনিত রোগের উপসর্গের মধ্যে মিল রয়েছে জানিয়ে ডা. আব্দুল্লাহ বলেন, করোনার মহামারি চলছে। সর্দি-কাশি ও জ্বর নিয়ে অবহেলা করা ঠিক হবে না। করোনা টেস্ট করিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।

 

ভোরের আকাশ/নি

 

মন্তব্য

Beta version