-->

করোনার চতুর্থ ঢেউ!

নিখিল মানখিন

করোনার চতুর্থ ঢেউ!
প্রতীকী ছবি

দেশের করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে এ চিত্র ফুটে উঠেছে। দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের হার ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে চলে যাওয়ায় দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

- জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে অবনতির চিত্র

-স্বাস্থ্যবিধি না মানলে পরিস্থিতি ভয়াবহ হবে

- বাড়াতে হবে নমুনা পরীক্ষা

শুধু তাই নয়, বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর সরকারি উদ্যোগ ও মানুষের সাড়া নেই। দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে দেশের করোনা পরিস্থিতি আবার ভয়াবহ রূপ নেবে। মানুষের উদাসীনতার কারণেই করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। করোনার ভয়াবহতার কথা ভুলে গেছে মানুষ।

করোনাবিষয়ক আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির ধারাবাহিক অবনতির চিত্র ফুটে উঠেছে। গতকাল সোমবার বিকাল সাড়ে ৪টায় আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানভিত্তিক ওয়েবসাইটের প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের মহামারিতে জর্জরিত বিশে^র দুই শতাধিক দেশের মধ্যে দৈনিক শনাক্তকৃত নতুন করোনা রোগী সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশ ৬৮তম থেকে ৬৩তম, মোট আক্রান্তের সংখ্যার ভিত্তিতে ৪৭তম থেকে ৪৪তম স্থানে, মোট মৃত্যু সংখ্যার বিবেচনায় ৩৯তম স্থান থেকে ৩৫তম স্থানে চলে এসেছে।

এই হিসাব অনুযায়ী একটি দেশ যত বেশি সামনের দিকে এগিয়ে যাবে ওই দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি তত বেশি বোঝাবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন করোনার চতুর্থ ঢেউয়ে আক্রান্ত। প্রতিবেশী দেশ ভারতে অনেক আগেই চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে। এবার সেই ঢেউ লেগেছে বাংলাদেশে। এক মাস ধরে ধারাবাহিকভাবে দেশের করোনা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে। আর গত কয়েক দিন ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দৈনিক শনাক্তকৃত নতুন রোগী ও শনাক্তের হার।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘন্টায় শনাক্ত হয়েছেন ২ হাজার ১০১ জন নতুন রোগী এবং শনাক্তের হার ১৫ দশমিক ২০। মারা গেছেন দুজন। এর আগের দিন শনাক্ত হয়েছিল ১ হাজার ৬৮০ জন এবং শনাক্তের হার ছিল ১৫ দশমিক ৬৬। ওই দিনও করোনায় দুই জনের মৃত্যু ঘটে।

গতকাল পাঠানো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এপিডেমিওলজিক্যাল রিপোর্ট অনুযায়ী, ২৪তম সপ্তাহের (১৩ থেকে ১৯ জুন) তুলনায় ২৫তম সপ্তাহে (২০ থেকে ২৬ জুন) নতুন রোগী শনাক্তের হার ২৯৯ দশমিক ৯ এবং করোনায় মৃত্যুর হার ৯০০ বৃদ্ধি পেয়েছে। করোনাভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলা করতে মাস্ক পরার কোনো বিকল্প নেই বলে মনে করেন প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ। ভাইরাসটির নতুন ধরন দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়ায় উল্লেখ করে সবাইকে সতর্ক করেছেন তিনি।

গতকাল রাজধানীতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) আয়োজিত একটি সেমিনারে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সবাইকে হাত ধোয়ার অভ্যাস চর্চা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। করোনাভাইরাসের নতুন ধরন যথাযথভাবে মোকাবিলা করার জন্য দ্রুত কোভিডের টিকা গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ আরও বলেন, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন দ্রুত এবং ব্যাপকভাবে ছড়ায় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি প্রায় ১০ জনকে সংক্রমিত করতে পারে। তবে সংক্রমণের হারে বৃদ্ধি পেলেও আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই।

তবে করোনাভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ মোকাবিলায় লকডাউনের মতো পদক্ষেপের প্রয়োজন পড়বে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবে বেপরোয়াভাবে চলাচল বা স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা যাবে না।

অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, দৈনিক করোনা সংক্রমণের হার যেভাবে দ্রুত বেড়ে চলেছে, দেশে করোনার চতুর্থ ঢেউ শুরু হয়েছে বলে আমরা ধরে নিতেই পারি। সব দেশেই করোনা সংক্রমণের উঠানামা চলে আসছে। কয়েক সপ্তাহ আগেও দেশে সংক্রমণের হার এক শতাংশের নিচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ হয়ে যায়নি করোনার সংক্রমণ। তাই সংক্রমণ যতদিন অব্যাহত থাকবে, তত দিনই সতর্ক থাকতে হবে। মানুষের উদাসীনতার কারণেই করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটছে। করোনার ভয়াবহতার কথা ভুলে গেছে মানুষ। সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিকল্প নেই বলে জানান অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ।

সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, আমরা চতুর্থ ঢেউয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছি। ওমিক্রনের নতুন এক সাব-ভ্যারিয়েন্ট দেখা দিয়েছে। এই ভ্যারিয়েন্ট অনেক বেশি সংক্রামক। রাজধানীতে রোগী বেশি। এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। ঈদে অনেকেই বাড়িতে যাবে। তখন সংক্রমণ বাড়তে পারে।

দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যাবে জানিয়ে তিনি বলেন, সরকারের উচিত এই ভাইরাসের রোগতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ করা। ক্রাশ প্রোগ্রাম চালিয়ে সবার মধ্যে টিকা নিশ্চিত করা। জিনোম সিকোয়েন্সিং করে ভাইরাসটি কোথা থেকে আসছে তা বের করতে হবে। বাইরে থেকে আসলে বিমানবন্দরগুলোতে নিরাপত্তা আরো জোরালো করতে হবে। আর দেশেই ছড়ালে ভিন্ন ব্যবস্থা নিতে হবে। আইসোলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আগামী ১৪ দিন ব্যাপক কর্মসূচি নিলে ১৪ দিন পর ভাইরাসটি স্থিতিস্থাপকতা পর্যায়ে থাকবে এবং পরের ১৪ দিনে কমে যাবে।

হঠাৎ করে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে সবার মধ্যে এক ধরনের উদাসীনতাকে দায়ী করছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও করোনা মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি বলেন, এখন আর কেউ স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। রাস্তায় অনেকেই আর মাস্ক পড়ছে না। সরকারের মধ্যেও কিছুটা উদাসীনতা দেখা গেছে। আমাদের জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটির মিটিং নিয়মিত হচ্ছে না। কয়েক মাস আগে সবশেষ মিটিং হয়েছে।

এদিকে, গত রোববার দুপুরে আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশে (আইসিডিডিআরবি) আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, ইদানীং করোনার সংক্রমণ বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ সময় করোনা শনাক্তের জন্য বেশি নমুনা পরীক্ষা করা দরকার। আমরা কিছুটা চিন্তিত, আতঙ্কিত নই।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, আমরা দেশের টার্গেটকৃত প্রায় সবাইকেই টিকার আওতায় এনেছি। এতে সংক্রমণ এক-শতাংশের নিচে চলে এসেছিল। আমাদের মৃত্যু প্রায় শূন্যের কোটায়। কিন্তু এখন আবার সংক্রমণের হার ১৫ শতাংশে ওঠে এসেছে। সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি।

জাহেদ মালেক বলেন, করোনায় মন্ত্রণালয়ের অনেকেই আক্রান্ত হয়েছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর অফিসেও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এ অবস্থায় আমাদের সচেতন হতে হবে। সবাইকেই মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আমরা বেশি বেশি করোনা পরীক্ষার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি বলে জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

মন্তব্য

Beta version