-->

হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা নাটকের সোনালি দিন

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
হারিয়ে যাচ্ছে বাংলা নাটকের সোনালি দিন

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: নব্বইয়ের দশকেও বাংলা নাটকের জমজমাট দিন ছিল। একমাত্র বিনোদন মাধ্যম ছিল বাংলাদেশ টেলিভিশন। যেখানে দেখানো হতো গল্পনির্ভর সাপ্তাহিক নাটক। পাশাপাশি দেখা যেত জনপ্রিয় সব ধারাবাহিক। কোথাও কেউ নেই, আজ রবিবার, সংশপ্তক, রূপনগর এ ধরনের নাটকের জন্য অপেক্ষা করতেন সবশ্রেণির দর্শক। নাটক প্রচারের দিন সন্ধ্যার পরই ফাঁকা হয়ে যেত রোড-ঘাট। সবাই ঘরে ফিরতেন এসব নাটক দেখার জন্য। গ্রামের চায়ের দোকাকে ভিড় জমাতেন একশ্রেণির দর্শক। সপ্তাহজুড়ে চলত সে আলোচনা। নাটকের এক চরিত্রের (বাকের ভাই) ফাঁসি হওয়ার কারণে দর্শকরা মিছিল নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েছেন এমন ঘটনাও রয়েছে। ৯০ দশকের পরও ভবের হাট, সাকিন সারিসুরি, রঙের মানুষ এ ধরনের নাটক তৈরি হয়েছে। এরপর সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে মান হারাতে বসেছে বাংলা নাটক।

 

সম্প্রতি প্রচুর চ্যানেল এবং ইউটিউব হওয়ায় তৈরি হচ্ছে অসংখ্য নাটক, যার বেশিরভাগেরই মান থাকছে না। এতে বাংলা সিনেমার মতো নাটকেরও দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, বিভিন্ন কারণে কমে যাচ্ছে বাংলা নাটকের মান। ভালো গল্প, ভালো নাট্যকার, ভালো পরিচালক, অর্থলগ্নি দাতা, কম বাজেট, সময়ের স্বল্পতা সব মিলেই নাটকের মান ঠিক থাকছে না। সংশ্লিষ্টদের মতে, এখন সবকিছু ভুলে নাটক তৈরি হচ্ছে হাতে গোনা কিছু শিল্পীর ওপর নির্ভর করে। চলছে সিন্ডিকেট। চ্যানেলগুলোও রয়েছে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য। যে কারণে ইচ্ছে থাকলেও ভালো নাটক তৈরি করতে পারছে না অনেকে। আশি ও নব্বই দশকে মোস্তাফিজুর রহমান, মোস্তফা কামাল সৈয়দ, নওয়াজেশ আলী খান প্রমুখ নির্মাতাদের ধ্যান-ধারণায় ছিল কীভাবে স্বল্প লজিস্টিক সাপোর্টেও একটি ভালো নাটক দর্শকদের উপহার দেয়া যায়। আউটডোরে শুটিংয়ের ব্যবস্থা সহজলভ্য না থাকায় বিটিভির নিজস্ব ভবনেই তারা সেট নির্মাণ করে সেখানে নাটক নির্মাণ করতেন। সেসব নাটকের গল্প ও নির্মাণশৈলী এতটাই স্ট্রং হতো যে দর্শকদের কাছে সেগুলো মোটেই একঘেঁয়ে লাগত না। তখন খান আতাউর রহমান, হুমায়ূন আহমেদ, আহমদ জামান চৌধুরী, মমতাজউদ্দীন আহমদের মতো বিখ্যাত চিত্রনাট্যকাররা সাফল্যের সঙ্গে ভাষার সুন্দর প্রয়োগ ঘটাতেন। কিন্তু দিনে দিনে ভাষার ‘স্মার্টনিটি’ কেটে গেছে। এখন যে যেখানে যেমন ইচ্ছা শব্দ ব্যবহার করে সংলাপ লিখছেন। আর শিল্পীরা সেগুলো ধারণ করে দর্শকের কাছে তুলে দিচ্ছেন। বর্তমানে নাটকে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে অশুদ্ধ বাংলা শব্দ। বাড়তি আয়ের জন্য জুড়ে দেয়া হচ্ছে অশ্লীল শব্দ। পাশিপাশি জুড়ে দেয়া হচ্ছে আপত্তিকর দৃশ্য। কখনো আবার কাস্টিং কাউচের কবলে পড়ে নাট্যকারকে বাধ্য হয়েই অপ্রয়োজনীয় চরিত্র তৈরি করতে হচ্ছে। একই কারণে বাদ পড়ছেন অনেক গুণী শিল্পী, যা ভালো নাটক তৈরির অন্তরায়।

 

বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হলে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা শামীম জামান ভোরের আকাশকে বলেন, ভালো নাটক তৈরি হচ্ছে না, বিষয়টি তেমন নয়। প্রচুর কাজ হচ্ছে, এর মধ্যে অনেক ভালো কাজ রয়েছে। হয়তো মানহীন কাজ বেশি হচ্ছে এটা ঠিক। আসলে ভালো কাজ করার জন্য অনেকগুলো বিষয় থাকে। ভালো নাট্যকার, ভালো পরিচালক, দক্ষ শিল্পী সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও ভালো কাজ হয়। এখন এর অভাব রয়েছে। এখন অনেকে নাটক বানাচ্ছেন যাদের কেউ চেনেন না। এদের নাটক চলে শিল্পীর নামে। তাছাড়া বাজেট স্বল্পতা রয়েছে। এসব কারণে নাটকের মান কমছে। এদিকে কোনো ধরনের মান বিবেচনা না করে ইউটউবে নাটক প্রচারের সুযোগ থাকায় বুঝে না বুঝে নাটক বানাচ্ছেন অনেকে। এদের মূল্য উদ্দেশ্য থাকে কত ভিউ হলো তা দেখা এবং ইনকাম করা। ফলে অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও এ ধরনের কাজ (নিম্নমানের) করছেন।

 

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নাট্যকার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘একবার আমাকে একজন গুণী অভিনেতা দেখা করার জন্য বলেন। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পাওয়া এ অভিনেতার আমন্ত্রণে তার কাছে যায়। ধারণা ছিল উনি নিশ্চয় ভালো কাজের অফার দেবেন। তিনি আমার কাছ থেকে কিছু গল্প শুনে বললেন, আমি আসলে এমন ইউটিউব কন্টেন বানাতে চাচ্ছি, যা শ্রমিক টাইপের মানুষে দেখবে। কিছু দৃশ্য থাকবে। বাসায় ফিরে সেই অভিনেতার সহকারীকে বললাম কাজটি করা সম্ভব নয়। তার মতো অভিনেতা যদি এমন করেন, তাহলে অন্যদের কথা কী বলব।

 

জ্যেষ্ঠ অভিনেতা আজিজুল হাকিমও টিভি নাটকের অতীত-বর্তমান নিয়ে নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আগে নাটকের মধ্যে একটা বাস্তবতা থাকত, সোশ্যাল কমিটমেন্ট থাকত। নাটকের গল্পের মাধ্যমে জনসচেতনতামূলক বক্তব্য আমরা দর্শকের সামনে তুলে ধরতাম। পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে টিভি নাটক দেখতাম। তাই আগে গল্পগুলোও কিন্তু সেভাবেই সাজান হতো। পরে বেসরকারি টিভি চ্যানেল সম্প্রচারে আসার পর সবকিছুই বৃদ্ধি পেতে থাকে। জেনারেশনের পরিবর্তনের সঙ্গে কিন্তু নাটকের পরিবর্তনও এসেছে। কারিগরি দিকটায় আমরা অনেক সমৃদ্ধ হয়েছি। নাটকের গল্পের ধরনও পরিবর্তিত হয়েছে। বেশি কাজ হওয়ায় এর কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা এখন কিছুটা কঠিন হয়ে পড়ছে। আগে নাটকে পরিবারের গল্প থাকত বেশি। এখন সেটা অনেক কমে গেছে। বাজেট কন্ট্রোল করার জন্য গল্পের ধরনও পরিবর্তন করা হচ্ছে।’ অন্যদিকে বাজেট কম থাকায় নাটক থেকে চরিত্র ছেটে ফেলা হচ্ছে। বিশেষ নাটকে, বাবা-মা, দাদা-দাদি, নানা-নানী এসব চরিত্র থাকছে না। এতেও নাটকের মান কমছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

 

জানতে চাইলে অভিনেত্রী অরুণা বিশ্বাস বলেন, এখন সিনিয়র শিল্পীদের নিয়ে কাজ হচ্ছে না বললেই চলে। যা হচ্ছে, তা-ও সিন্ডিকেট। যারা কাজ করছেন ঘুরেফিরে তারাই। এভাবে চললে নাটক বা চলচ্চিত্র কিছুই আগোতে পারবে না। বিজ্ঞরা বলেন, যেকোনো সংস্কৃতিচর্চার জন্য ভাষা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভাষার অপপ্রয়োগে অধঃপতন হতে পারে অনেক শক্ত ও মজবুত শিল্পেরও। সেই অধঃপতনের দিকেই যেন হাঁটছে এদেশের নাট্য শিল্প! নব্বই দশকে ঢাকাই ছবি বা নাটকে ভাষার যে শানিত উচ্চারণ ও আবেদন ছিল, কালক্রমে তা হারিয়ে গেছে। সেখানে দখল নিয়েছে আঞ্চলিক ভাষাগুলো। সেগুলোও উঠে আসছে ভুল উচ্চারণ ও অর্থ নিয়ে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version