-->

কে তাদের মনে রাখে

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
কে তাদের মনে রাখে

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: একসময় আলো-ঝলমল পরিবেশে দিন কাটত তাদের। লাইট-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মধ্যে পার হয়ে যেত কাকডাকা ভোর থেকে মাঝ রাত। সকালে এফডিসিতে শুটিং তো বিকালে গাজীপুরে। আজ মানিকগঞ্জের ঝিটকা তো কাল কক্সবাজার। কাজের প্রয়োজনে যেতে হতো থ্যাইল্যান্ড, আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, লন্ডনসহ তামান দুনিয়ায়। তাদের সিডিউল না পেয়ে মন খারাপ করে ফিরে যেতেন পরিচালকরা। ব্যস্ততার মাঝে ক্ষণিক অবসর খুঁজতেন তারা। কিন্তু সহসা মিলত না অবসর। সবার কথা চিন্তা করে অক্লান্ত কাজ করে যেতেন তারা। এভাবেই গড়িয়ে গেছে দিন। সূর্য পশ্চিমাকাশে ঢলে পড়েছে। কালের ফেরে একসময়ের লাস্যময়ী নায়িকা এখন প্রৌঢ়। তরুণ নায়ক এখন বৃদ্ধ। এর মধ্যে তাদের ভুলে গেছেন সংশ্লিষ্ট সবাই। চলচ্চিত্র-নাটকে তাদের চরিত্র নেই। কেউ খোঁজ রাখেন না তাদের। ফলে একসময় যারা অবসর খুঁজতেন এখন তাদের অখন্ড অবসরে থেকে ভাবেন এই বুঝি ভালো চরিত্রের প্রস্তাব আসে।

 

পৃথিবীর অন্য দেশে নানা ধরনের গল্পে কাজ করেন বয়োজ্যেষ্ঠ শিল্পীরা। মুখ্য, জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে দেখা যায় তাদের। বাংলাদেশে এরকম চরিত্রে খুব কম শিল্পীকেই দেখা যায়। অথচ অভিজ্ঞতার কারণে শক্তিশালী চরিত্রে কাজ করতেই পারতেন তারা। বাধাই হো ছবিতে আয়ুষ্মান খুরানার দাদির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ৭৫ বছর বয়সি সুরেখা সিক্রি। সেই চরিত্রের জন্য সে বছর সেরা সহঅভিনেত্রী হিসেবে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার নিয়েছেন তিনি। সেসময় দর্শকসারির সবাই আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাকে। ভারতে অমিতাভ বচ্চন, রত্না পাঠক, নাসির উদ্দীন শাহ, রেখা, মাধুরী এখনো অভিনয় করেন। তাদের নিয়ে অন্যরকম সব গল্প ফাঁদেন গল্পকাররা। পরিচালকরাও গল্পের চরিত্রগুলোকে পর্দায় তুলে আনেন। অথচ বাংলাদেশে ৫০ থেকে ৬০ ছুঁলেই কোনো শিল্পীকে নিয়ে যেন ভাবতে ভুলে যান গল্পকার ও পরিচালকরা। কালেভদ্রে দুয়েকটি ভিন্ন কাজ চোখে পড়ে।

 

এসব শিল্পী আক্ষেপ করে বলেন, একমাত্র ভোটের সময় কেউ কেউ যোগাযোগ করেন। এরপর আবার ভুলে যান। আমার এখন ভাঙা হাটের হাটুরে। এদিকে জ্যেষ্ঠদের জন্য ভালো চরিত্র না থাকায় এ অঙ্গন থেকে অনেকে দূরে সরে গেছেন। দুই দশকের বেশি সময় ধরে অভিনয়ে নেই জনপ্রিয় অভিনেত্রী শাবানা। পরিবার নিয়ে পাড়ি জমিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও তিনি নিজ থেকেই চলচ্চিত্রকে বিদায় দিয়েছেন। সুচরিতা, চম্পা, রোজিনা, অঞ্জনা, ববিতা, কবিতা, জিনাতদের আর দেখা যায় না।

 

একসময়ের পর্দাকাঁপানো নায়িকা শবনবকে শেষবার দেখা দিয়েছেন ১৯৯৯ সালে, আম্মাজান ছবিকে। অঞ্জুকে বাংলা ছবিতা দেখা যায় না দীর্ঘকাল। যদিও দুই বছর আগে একটি একটি ছবিতে তিনি অভিন করেছেন। তবে তা এখনো মুক্তি পায়নি। একই অবস্থা একসময়ের জনপ্রিয় নায়কদের ক্ষেত্রেও। ফারুক, প্রবীর মিত্র, আলমগীর, উজ্জ্বল, সোহেল রানা, রুবেল, বাপ্পারাজ, ইলিয়াস কাঞ্চনরা অভিনয়ে অনিয়মিত। অথচ চাইলে তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে অনন্য সব সিনেমা বানানো সম্ভব।

 

জানতে চাইলে জনপ্রিয় নায়ক বাপ্পারাজ ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে সময় বদলে গেছে। এখন সবার ব্যবসায়িক মনোভাব। কম বাজেট। ভালো গল্প কম। যেসব গল্প তৈরি হচ্ছে তার বেশিরভাগেই আমাদের কাজ করার সুযোগ থাকে না। হয়তো জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের কথা না ভেবেই গল্প লেখা হয়। সেজন্য আমরা কাজ করতে পারি না। মাঝেমধ্যে কাজের অফার পেলেও চরিত্রের গুরুত্ব না থাকার কারণে অভিনয় করা হয় না। তবে ভালো চরিত্রের জন্য অপেক্ষা করি। ভালো গল্প পেলে এখনো নিয়মিত কাজ করতে চাই। বিষয়টি নিয়ে কথা উঠতেই চিত্র নায়িকা নার্গিস আক্তার বলেন, ‘একসময় পরিচালকরা আমাদের সিডিউল পেতেন না। তখন ছিল চলচ্চিত্রের সোনালি দিন। ভালো মানের গল্প ছিল। সেসব গল্পে জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের গুরুত্ব দেয়া হতো। আমরা অনেক জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের সঙ্গে কাজ করেছি। এতে আমরা কিছু শিখতে পারতাম। এখন আর সেদিন নেই। এখন নায়ক-নায়িকার পথে দেখা, পথে পরিচয় বাসরে কাহিনী শেষ বেশিরভাগই এমন কাহিনি নিয়ে চলচ্চিত্র-নাটক হচ্ছে। নায়ক-নায়িকার বাবা-মা, দাদা-দাদি বা অন্য কোনো চরিত্র ভাবা হচ্ছে না। যে কারণে আমাদের দিন ফুরিয়েছে। খুব দরকার ছাড়া এখন আর কেউ আমাদের খোঁজ রাখেন না।

 

একই বিষয়ে কথা হলে চিত্রনায়িকা অরুণা বিশ^াস বলেন, ‘পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সিনিয়র শিল্পীদের কথা মাথায় রেখে চলচ্চিত্র-নাটক তৈরি হয়। কিন্তু আমাদের দেশে হয় এর বিপরীত। এখানে শুধু নায়ক-নায়িকাকে প্রধান করে গল্প লেখা হয়। তৈরি হয়েছে সিন্ডিকেট। ফলে কিছু কাজ করার জায়গা থাকলেও সেখানে নির্দিষ্ট কিছু শিল্পী কাজ করছেন। ফলে ঘুরেফিরে একই মুখ দেখা যাচ্ছে। আছে রাজনীতিও। যে কারণে আমরা কাজ করতে পারিনি। অনেক সময় কাজের অফার পেলেও নিজের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। পরিচালক বলে দেন, একটা মায়ের চরিত্র আছে এটা আপনি করবেন। যেন শিল্পীর যেকোনো স্বাধীনতা নেই। এ প্রবণতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে সিনিয়র শিল্পীদের আর কাজের সুযোগ হবে না।’

 

প্রবীণ অভিনেতা প্রবীর মিত্র বলেন, এখন আমি অসুস্থ তবু কাজ করতে চাই। কিন্তু কেউ আমাদের ডাকে না। আমরা অভিনয়ের মানুষ। অভিনয় ছাড়া কিছু ভাবতে পারি না। এখনো অপেক্ষায় থাকি ভালো কাজের ডাক পাব।

 

বিষয়টি নিয়ে কথা বললে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পরিচালক বলেন, এর কারণ চলচ্চিত্র পরিচালকদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা। বিশ^জুড়ে নানা ধরনের গল্প নিয়ে ছবি হয়। সেখানে মুখ্য, জটিল আর গুরুত্বপূর্ণ সব চরিত্রে দেখা দেন বয়স্ক শিল্পীরা। ৫০ বা ৬০ বছর পেরোনো অভিনয়শিল্পীরাও যেকোনো সিনেমার শক্তিশালী চরিত্র হয়ে উঠতে পারেন, তা নিয়ে কেউ ভাবেনি, ভাবে না। জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের নিয়ে সিনেমা বানানোর বিষয়টি পরিচালকদেরই ভাবতে হবে। একবার কেউ শুরু করলে সেটাকে ছাড়িয়ে যেতে অন্যরাও চেষ্টা করত বলে মনে করেন চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তারা আরো মনে করেন, চর্চার অভাব, মনোজগতের সীমাবদ্ধতা, বৈচিত্র্য খোঁজার মানসিকতা না থাকায় বয়স্ক শিল্পীদের নিয়ে গল্প ভাবতে পারেন না তারা।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version