-->
শেষ পর্ব

হারিয়ে যাচ্ছে পুতুলনাচ

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
হারিয়ে যাচ্ছে পুতুলনাচ
বাঙালি জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা চলচ্চিত্র, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, পুঁথি পাঠ, গাজিকালুর কিচ্ছাসহ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। কালের বিবর্তনে এখন এসব হারাতে বসেছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অনেক। কিছু এখনো টিকে আছে। সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা নিয়ে ভোরের আকাশের এ আয়োজন।

ঢাকা: ‘ভোম্বল দাশের কম্বল খান/কম্বল ধরে দিল টান/বর্ধমানের পোলাপান/বাপরে বলে হুক্কা আন/হুক্কার মধ্যে ছিল পানি/হয়ে গেল জানাজানি/আমরা হুক্কা টানি না/হুক্কার খবর জানি না অথবা বাংলা জানে না বাবু ইংরেজিতে নমস্কার/মাঝে মাঝে হ্যান্ডসেক করে/গুডমনিং গুডমনিং স্যার’- এভাবে ছড়া কেটে গান গেয়ে একসময় সারা দেশে পুতুলনাচ দেখানো হতো। ছেলে-বুড়ো সবাই মুগ্ধ হয়ে দেখতেন নানা কাহিনীতে ভরপুর এসব নাচ। একসময় গ্রাম-শহর সব জায়গায় পুতুলনাচ জনপ্রিয় হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই দিন হারাতে বসেছে। খাদের কিনারায় রয়েছে এ শিল্প। কালের গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাচ।

গ্রামীণ জনপদে পহেলা বৈশাখসহ যেসব মেলা হতো, সেসব মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল পুতুলনাচ। সামাজিক বিভিন্ন বিষয়, পালাগান, পৌরাণিক কাহিনী ফুটিয়ে তোলা হতো পুতুলনাচের মাধ্যমে। মেলায় ১০ থেকে ১৫ দিন ধরে পুতুলনাচ পালা চলত। কখনো ‘রাজা হরিশ্চন্দ্র’ কখনো মোল্লা নাসিরউদ্দিনের গল্প আবার কখনো নেহাত সামাজিক পালা ও হাস্যরস দিয়ে দর্শক সমাদর পেয়েছে দলগুলো। পুতুলনাচ লোকনাট্যের অন্যতম প্রতীক। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে একে বলে ‘পাপেট’।

 

একসময় গ্রামীণ জনপদে আবালবৃদ্ধবনিতা ও শিশুদের বিনোদনে পুতুলনাচ একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এখকার প্রজন্মের অনেকে পুতুলনাচের নাও শুনিনি। কিংবা নাম শুনলেও কীভাবে এটা প্রদর্শন করা হয়, তা জানে না। মোবাইল ইন্টারনেটের যুগে এসে পুতুলনাচ এখন শুধু ফ্রেমে বাঁধা স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে। আগের মতো পুতুলনাচে জৌলুস না থাকায় এ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা অন্য পেশায় চলে যাচ্ছে। ফলে খুব দ্রুত এ লোকনাট্যের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাচ্ছে বলে আশঙ্কা করছেন শিল্পসংশ্লিষ্টরা।

 

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিপিন পাল ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম পুতুলনাচের প্রচলন করেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। কালক্রমে তা ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন স্থানে। পরে এ শিল্পের হাল ধরেন জেলার কৃষ্ণনগর গ্রামের গিরীশ আচার্য, তার মিয়া, ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মেড্ডা এলাকার ধন মিয়া, কালু মিয়া, রাজ হোসেন ও পৌর শহরের কাজীপাড়া এলাকার শরীফ মালদার। কিন্তু প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখা গেলেও এখন শিল্পী সংকট দেখা দিয়েছে। অন্য পেশায় আর্থিকভাবে লাভবান হন বলে শিল্পীরা এ পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। বেঁচে থাকার জন্য শিল্পীরা কেউ শ্রমিকের কাজ করছেন। কেউ মুদি দোকনি কেউ বেছে নিয়েছে ভিন্ন কোনো পেশা।

নাট্যতাত্ত্বিক গর্ডন ক্রেইম বলেন, পুতুলনাচ নাটকের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটিনিকায় বলা হয়, ‘পাপেট ক্যান প্রোভাইড এ ডিগ্রি অব অ্যাবস্ট্রেট্রেন অ্যান্ড স্টাইলিসেসন আন-অ্যাটেইনেবল বাই হিউমেন অ্যাক্টরস’। নাট্যতাত্ত্বিকদের এত বড় উদাহারণ থাকার পরও দেশে পুতুলনাচ লোকশিল্পের মাধ্যমে বেশি দূর এগোয়নি। উল্টো ধ্রুপদী শিল্পের এ বাহনকে দিনে দিনে কলুষিত করে পুতুলনাচের আড়ালে অশ্লীল নাচ পরিবেশন করতে দেখা যায় বিভিন্ন মেলায়। ফলে পুতুলনাচ বা যাত্রার বদলে সবাই এসব দেখতে মরিয়া থাকেন।

 

আগে গ্রামের হাটে, চায়ের দোকানে পুতুলনাচের গল্প করতে শোনা যেত। রাতে গ্রামের ছেলে-বুড়োরা পুতুলনাচের গল্প করতে। পান খেতে খেতে গৃহবধূ, কিষান কন্যারাও মেতে উঠতেন সে গল্পে। আজকাল সেসব আর হয় না। গ্রামগুলোয় শহুরে হাওয়া প্রবেশ করেছে যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে। এখন আর অনেক কিছুই আগের মতো নেই। সেইসঙ্গে নেই পুতুলনাচের ঐতিহ্যও।

 

সংশ্লিষ্টরা বলেন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধেও পুতুলনাচের ভূমিকা আছে। দলে দলে মানুষ তখন শরণার্থী শিবিরে যাচ্ছিল। দেশটি ছেড়ে যাওয়ার কষ্ট বুকে পুষে রেখেছিল তারা। শরণার্থী ক্যাম্পের দিনগুলোয় তারা নিশ্চয়ই ভাবত দেশ নিয়ে। কেমন আছে প্রিয় স্বদেশ? সেই দুঃসহ সময়টায় এসব মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে পুতুলনাচ করা হতো। সেখানে হানাদারদের কাহিনী থাকত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী।

পুতুলনাচ নিয়ে গবেষণা করেন অধ্যাপক ড. হারুন রশিদ। তিনি দীর্ঘদিন পুতুলনাচ নিয়ে গবেষণা করে ৫০-৬০টি দলের নাম উদ্ধার করতে পেরেছেন যারা পুতুলনাচ করে। তবে বর্তমানে মাত্র ২০-২৫টি দল পুতুলনাচ চর্চাকে লালন করে আসছে।

 

তিনি জানান, বাংলাদেশের পুতুলনাচের কথা বলতে গেলে ধন মিয়ার কথা উল্লেখ করতে হয়। পুতুলনাচের মধ্যে নতুনত্ব এনেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রয়াত এ পুতুলনাচের কুশলী।

 

পুতুলনাচের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী বলেন, ছোটবেলায় আমাদের গ্রামে একটি ধনি লোক ছিলেন। তার পেশা ছিল ছিল পুতুলনাচ। বছরে ৬ মাস পুতুলনাচ দেখিয়েই তিনি বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হয়েছিলেন। এতটাই জনপ্রিয় ছিল পুতুলনাচ। কিন্তু কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই যেমন আজ আর নেই, তেমনি নেই পুতুলনাচের সেসব সোনালি দিন। ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সবাই চাইছে যে আমাদের ঐতিহ্যবাহী শিল্পটা বেঁচে থাকুক, তাই অনেক পেশাদার শিল্পী ধর্মনিরপেক্ষভাবে পুতুলনাচের দল গঠন ও পরিচালনা করে যাচ্ছেন। আর এ চাওয়াটার কারণে বাংলাদেশে দলগুলো টিকে আছে।

 

একই বিষয়ে চিত্রনায়িকা ও যাত্রাশিল্পী অরুণা বিশ্বাস বলেন, যাত্রার মতো পুতুলনাচও আমাদের সংস্কৃতির অংশ। ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় এ শিল্প বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবাই এগিয়ে এলেই শুধু এ শিল্প রক্ষা। তবে যেকোনো মূল্যে আমাদের এ শিল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখতে হবে।

 

মনোবিজ্ঞানীরা বলেছেন, যেসব শিশু ছেলেবেলায় পুতুল খেলে তারা সংসার জীবনে সার্থক হয়! পুতুল এবং পুতুলনাচ এক জমজমাট সময় পার করেছে বাংলাদেশে। পুতুলনাচ এমন একটি আর্ট যেখানে শিল্পকলার প্রায় সব উপাদান বিদ্যমান। গল্প, কবিতা, নাটক, অভিনয়, গান, নাচ, ভাস্কর্য এবং অন্যান্য দৃশ্যমান আর্টের সার্থক মিলন ঘটেছে পুতুলনাচে।

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version