-->
পর্ব ২

মহাসংকটে যাত্রাপালা

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
মহাসংকটে যাত্রাপালা
বাঙালি জীবনের সঙ্গে মিশে আছে বাংলা চলচ্চিত্র, যাত্রাপালা, পুতুলনাচ, বায়োস্কোপ, জারি, সারি, ভাটিয়ালি, কবিগান, পুঁথি পাঠ, গাজিকালুর কিচ্ছাসহ সংস্কৃতির নানা অনুষঙ্গ। কালের বিবর্তনে এখন এসব হারাতে বসেছে। এরই মধ্যে বিলীন হয়ে গেছে অনেক। কিছু এখনো টিকে আছে। সংস্কৃতির বিভিন্ন শাখা নিয়ে ভোরের আকাশের এ আয়োজন।

 

ঢাকা: সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ যাত্রাপালা। এটি ছিল একসময় বিনোদনের সেরা মাধ্যম। কবে ফসল তোলা শেষ হবে, কবে শীত আসবে এই অপেক্ষায় থাকতেন গ্রামবাংলার মানুষ। গ্রামে গ্রামে যাত্রাপালার আয়োজন করা হতো। কে কার চেয়ে ভালো যাত্রদল নিয়ে আসতে পারেন, তা নিয়ে চলত প্রতিযোগিতা। চারদিকে পিনপতন নীরবতা। গ্রামের কিশোর থেকে বৃদ্ধ সবাই উপস্থিত। ছেলেদের হাতে হুক্কা অথবা বিড়ি আর মেয়েদের হাতে পানের বাটা কিন্তু কারো মুখে কোনো শব্দ নেই, মঞ্চের ওপর, খালি গলায় দারাজ কণ্ঠে অভিনেতা আর অভিনেত্রীর একের পর এক সংলাপবিনিময় হচ্ছে। এরই মাঝে খলচরিত্রের আগমন ঘটল, তরবারি নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, চারদিকে তুমুল উত্তেজনা কার জয় হবে। এভাবে একটা সময় পালা শেষ হতো। নায়ক-নায়িকার দুঃখ দেখে চোখের পানি মুছতে মুছতে বাড়ি ফিরতেন সবাই। বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে একসময় এমন দৃশ্যই দেখা যেত। গ্রামের মতো নগরে যাত্রার আয়োজন হতো।

সময় বদলেছে। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচিও বদলে গেছে। এখন আর কেউ শীত আসার অপেক্ষায় থাকেন না। অপেক্ষায় থাকেন না যাত্রাপালার জন্য। বর্তমানে যাত্রাপালা মহাসংকটে পড়েছে। যাত্রার এই করুণ দশার কারণে বেকার হয়ে পড়েছেন এই শিল্পের মানুষগুলো। বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে তাদের অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

একসময় এদেশের গ্রামগঞ্জে সারা বছর লেগেই থাকত নবান্নের ধানকাটা, পূজাপার্বণ, ঈদ কিংবা গ্রামের কোনো প্রতিপত্তিশালী লোকের পুত্র বা কন্যার বিয়েÑ প্রতিটি উৎসবে যাত্রাপালা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। যে যাত্রা রাতের পর রাত জেগে বাংলার সাধারণ মানুষ, কৃষক, তাঁতি, কামার, কুমার, জেলে দেখেছে আর মেতেছে পালা গানের সুরে। আজ তা কালের বিবর্তনে একটি মৃতপ্রায় শিল্পমাধ্যম ছাড়া কিছু নয়, আবার অনেকের কাছে অশ্লীলতার কারখানা।

১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যখন অনেক যাত্রাদল পূর্ববঙ্গ ছেড়ে পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়, তখন পাকিস্তান সরকার যাত্রাপালা ধর্মবিরোধী কাজ- এমন কথা বলে ফতোয়া জারি শুরু করে। তারা কখনো বাংলার লোক সংস্কৃতিকে সুনজরে দেখেনি। এরপর স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যাত্রাপালা তার আগের রূপে ফিরতে পারেনি। যত দিন গেছে তা আরো নিম্নগামী হয়েছে। যদিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলে অনেক যাত্রাদল নতুনভাবে গড়ে ওঠে এবং ভালো এবং জনপ্রিয় কিছু যাত্রা তারা উপহার দেয় কিন্তু সত্তর দশকের শেষভাগ যাত্রাশিল্পে অবক্ষয় শুরু হয়। তবে যাত্রার ইতিহাস বহু প্রাচীন। বাঙালির অভিনয়ে প্রবেশ নাটকের মাধ্যমে হওয়ার আগে যাত্রার মাধ্যমে শুরু হয়, এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই। তবে সর্বজনবিদিতভাবে মনে করা হয়, হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেব-দেবির উৎসব যেমন দোলযাত্রা, শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমীতে কৃষ্ণযাত্রা, জগন্নাথ দেবের জন্য রথযাত্রা ইত্যাদি অনুষ্ঠানে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গান-বাজনার মিছিল নিয়ে যাওয়া শুরু করার পরই ধারণা করা হয়েছে, বিভিন্ন উৎসবে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় গান-বাজনা করতে করতে যাওয়া- এ ‘যাওয়া’ কথাটা থেকেই ‘যাত্রা’ কথাটির উৎপত্তি বলে বেশিরভাগ গবেষক ধারণা করে থাকেন ।

বিভিন্ন কারণে যাত্রার ভগ্নদশা হলেও মূলত অতি মুনাফালোভী মালিকদের খপ্পরে পড়ে গত তিন দশকে মুমূর্ষু হয়ে পড়েছে এই শিল্প। দুই দশক আগেও সারাদেশে তিন শতাধিক যাত্রাদল ছিল। কমতে কমতে এখন সর্বোচ্চ টিকে আছে মাত্রা ৩০টি। সরকার যাত্রাশিল্পের জন্য নীতিমালা ও নিবন্ধনের ব্যবস্থা করলেও এই শিল্পের মরণদশা কাটছে না। সারা দেশে অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে যাত্রাপালার অনুমোদন। কোনো কোনো জায়গায় ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের অনুরোধে ডিসি এবং এসপিরা অনুমোদন দিলেও যাত্রা-পুতুল নাচের নামে অশ্লীল-নোংরা নৃত্য, জুয়া-হাউজির আসর বসানোর কারণে স্থানীয় জনগণের চাপের মুখে তা আবার বন্ধ করে দেয়া হয়।

এ প্রসঙ্গে চিত্রনায়িকা ও যাত্রাশিল্পী অরুণা বিশ্বাস ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমানে যাত্রাশিল্প সংকটে পড়েছে। আগের মতো আর যাত্রাপালা হয় না। যতটুকু হয় তা কেবল অশ্লীল নাচ গানে ভরপুর। যখন থেকে যাত্রায় ‘প্রিন্সেস’ যুক্ত হয়েছে, মূলত তখনই এই শিল্প শেষ হয়ে গেছে। উঠে গেছে মূলধারার যাত্রা। কাজ না থাকায় এই শিল্পের অনেকেই পেশা বদল করেছেন। অনেকে খুব কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি পড়লে হয়তো এই শিল্পটা টিকে থাকবে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, যাত্রাশিল্পের অবক্ষয় এবং বিলুপ্তির পথে ধাবিত হওয়ার মূল কারণ অসাধু যাত্রাপালা ব্যবসায়ীদের ‘প্রিন্সেস’ আমদানি আর জুয়া-হাউজি চালু । তারা বলেন, এই শব্দগুলো আগে যাত্রাদলে ছিল না। ১৯৭৮-৭৯ সালের পর এই অশ্লীলতার সূচনা হয়েছিল মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে। তাদের কাছেই চিরায়ত যাত্রাপালার মৃত্যু ঘটে।

যাত্রাপালার সোনালি সময় ছিল ৬০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত। ৯০ দশকেও ছিল এই শিল্পের কদর। ১৯৮৭-৮৮ সালে যাত্রাদলের সংখ্যা বেড়ে তিন শতাধিক হয়। শিল্পকলা একাডেমিতে ১১১টি দল নিবন্ধন করেছে। তবে টিকে আছে ৩০টির মতো। গত বছরও ৫৭টি দল ছিল। প্রতিবছর কমছে। বাংলাদেশে আশ্বিন থেকে চৈত্র মাস পর্যন্ত সাত মাস যাত্রার ভরা মৌসুম। যাত্রার মৌসুম শুরু হয় দূর্গাপূজায় আর শেষ পহেলা বৈশাখে। এ বছর কোনো যাত্রাপালা হয়নি। এখন টিকে আছে এমন নামকরা যাত্রাদলগুলো হলো : নারায়ণগঞ্জের ভোলানাথ যাত্রা সম্প্রদায়, কোহিনূর অপেরা, গাজীপুরের দিশারী অপেরা, যশোরের আনন্দ অপেরা, চ্যালেঞ্জার অপেরা, অগ্রগামী নাট্যসংস্থা, মাগুরার চৈতালী অপেরা, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিতাস যাত্রা ইউনিট, খুলনার স্বদেশ অপেরা, রাজমহল অপেরা, বাগেরহাটের সুন্দরবন অপেরা, লক্ষ্মীপুরের কেয়া যাত্রা ইউনিট, রঙমহল অপেরা, দেশ অপেরা, নাটোরের পদ্মযাত্রা ইউনিট ইত্যাদি।

এদিকে উল্লেখযোগ্য যাত্রাপালার মধ্যে রয়েছে : কমলা রানীর বনবাস, মালকা বানু, রূপবান-রহিম বাদশাহ, সয়ফুল মুলুক বদিউজ্জামাল, গুনাইবিবি, দুর্গামনি, কাজল রেখা, মলুয়া, ভেলুয়া সুন্দরী, সোনাভান, বীরাঙ্গনা সখিনা, গাজী কালু চম্পাবতী, বনবিবি ইত্যাদি। জনপ্রিয়তা পায় : মাইকেল মধুসূদন, দেবদাস, সোজন বাদিয়ার ঘাট, রক্তাক্ত বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বিজয় এনেছি, মা মাটি মানুষ, সোনার বাংলা, লালন ফকির, ঈশাখাঁ, রক্তাত্ত প্রান্তর, এক যে ছিলেন মহারানী, দাতা হাতেম তাই, এই দেশ এই মাটি ইত্যাদি পালা।

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version