-->

কাজ করে অন্যজন বেতন পায় ইমরান

আরিফ সাওন, বাগেরহাট থেকে ফিরে
কাজ করে অন্যজন বেতন পায় ইমরান

আরিফ সাওন, বাগেরহাট থেকে ফিরে:  কাগজে-কলমে দপ্তরি হলেও স্কুলে আসেন না তিনি। অন্য লোক দিয়ে করান দপ্তরির কাজ। গত সাত বছরে নিজের কাজ করিয়েছেন অন্য তিনজন দিয়ে। তার এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে কথা বলে লাঞ্চিত হয়েছেন সাবেক প্রধান শিক্ষক। তাই এখন আর কেউ তার বিরুদ্ধে কথা বলেন না। কারণ তিনি নেতা। তিনি এলাকার প্রভাবশালী। বাবার অনেক জমিজমা। কেউ কিছু বললেই তাকে হতে হয় মিথ্যা মামলার আসামি। নিজের ক্ষমতায় বোন জামাইকে বানিয়ে রেখেছেন ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি।

 

বছরের পর বছর ধরে চলছে অনিয়ম। একটি ভিডিও এসেছে ভোরের আকাশের এ প্রতিবেদকের হাতে। তাতে দেখা গেছে, তিনি রামদা দিয়ে প্রকাশ্যে একজনকে কোপানোর জন্য তেড়ে যাচ্ছেন। তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা ও ছিনতাইসহ বিভিন্ন অভিযোগে মোরেলগঞ্জ থানায় ৫টি মামলা রয়েছে। দায়িত্ব পালন না করে সাত বছর ধরে বেতন তুলে নিলেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, তারা এ বিষয়ে অবহিত নন। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বলেছেন, উপজেলার সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ জানলেও তারা ব্যবস্থা নেন না। বলছিলাম এক ইমরান খানের কথা। ইমরান খান বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলার ১২নং জিউধরা ইউনিয়নের ৯৭নং একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রহরী কাম দপ্তরি। নিয়োগ পাওয়ার পর কখনোই তিনি দপ্তরির কাজ করেননি। কে করাবে তাকে দিয়ে দপ্তরির কাজ! এলাকায় প্রভাব বিস্তার, মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি ও প্রতিপক্ষকে মারধরসহ নানা অভিযোগ রয়েছে ইমরানের বিরুদ্ধে। তাই ভয়ে কেউ এখন আর তার বিপক্ষে অবস্থান নেন না।

 

গত বৃহস্পতিবার বেলা ১১ টার দিকে ওই স্কুলে গিয়ে দেখা যায়, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার ও সহকারী শিক্ষক নিয়াজ পারভেজ দায়িত্ব পালন করছেন। দপ্তরি ইমরানকে পাওয়া যায়নি। ইমরান স্কুলে আছেন কিনা জানতে চাইলে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার বলেন, ‘বাজারে গেছে’। তিনি ফোন করে ইমরানকে স্কুলে আসতে অনুরোধ করেন। কিন্তু ইমরান আসেন না। আসবেন কিভাবে। তিনি তো তখন বাজারে ছিলেন না। ছিলেন স্কুলে থেকে বেশ দূরে। ইমরান কাছাকাছি নেই শুনে, কথা বদলে ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘মোরেলগঞ্জ ব্যাংকে গেছে’।

 

এ সময় মুঠোফোনে সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার সজল মহলীর অনুমতি নিয়ে হাজিরা খাতায় দেখা যায়, দপ্তরি মো. ইমরান খান সর্বশেষ চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর স্বাক্ষর করেছেন। পুরো অক্টোবর মাস এবং নভেম্বরের ৩ তারিখ পর্যন্ত হাজিরা খাতায় কোনো স্বাক্ষর করেননি। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসের পুরো ৩০ দিন এবং অক্টোবরে ৩১ দিন দায়িত্ব পালন করেছেন মর্মে প্রতিবেদন দিয়ে পূর্নাঙ্গ ১৪ হাজার ৪৫০ টাকা বেতন প্রদানের জন্য সুপারিশ করেছেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক নিরঞ্জন কুমার। স্বাক্ষর না থাকার বিষয়টিও ধামাচাপা দিতে নিজের ঘাড়েই দোষ নেন ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক। বলেন, ‘ইমরান স্কুলে আসে, কিন্তু আমিই হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করাইনি।’ নিরঞ্জন কুমার বলেন, ‘হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর দেয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু সে (ইমরন) স্বাক্ষর দেয়নি।’ স্বাক্ষর ছাড়াই কেন পূর্নাঙ্গ বেতন পাওয়ার প্রতিবেদন প্রদান করেছেন, এমন প্রশ্নের কোনো সদুত্তর দেননি তিনি।

 

‘কাজ না করলেও প্রধান শিক্ষক কেন দপ্তরির পক্ষ নিচ্ছেন? রহস্য কি?’ প্রকাশ্যে কেউই বলতে রাজি হননি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ব্যক্তি জানালেন এর রহস্য। তিনি বলেন, ইমরান সাবেক প্রধান শিক্ষককে লাঞ্চিত করেছেন। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক যদি ইমরানের কথা মত না চলেন, তাহলে তিনি এখানে শিক্ষকতা করতে পারবেন না। এখান থেকে ছেড়ে পরিবার পরিজন নিয়ে অন্যত্র চলে যেতে হবে। তাই বাধ্য হয়ে তিনি ইমরানের কথা মতই সব কাজ করেন। বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক গোপাল কৃষ্ণ মণ্ডল বলেন, ‘২০১৫ সালের পরে আমি দুই বছর দায়িত্বে ছিলাম। এই সময়ে ইমরান কখনো দায়িত্ব পালন করেনি। তাকে দায়িত্ব পালন করতে অনুরোধ করায় আমাকে লাঞ্চিত হতে হয়েছে।’

 

বিদ্যালয় সংক্রান্ত কাগজপত্র ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২০১৫ সালের ২২ জানুয়ারি মোরেলগঞ্জ উপজেলার চন্দনতলা গ্রামের মো. ইউসুফ আলী খানের ছেলে মো. ইমরান খান ৯৭ নং একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দপ্তরি হিসেবে যোগদান করেন। যোগদানের পর স্থানীয় মো. আমিনুল ইসলাম নামের এক যুবককে মাসিক আড়াই হাজার টাকা মৌখিক চুক্তিতে তার কাজ করান।

 

আমিনুল বলেন, ‘আমি আড়াই বছর ইমরান খানের বদলে স্কুলে দপ্তরির কাজ করেছি। বিনিময়ে ইমরান আমাকে মাসে আড়াই হাজার করে টাকা দিত।’

 

আমিনুলের পরে কাজ করেন মো. রাসেল স্বর্নমদ। রাসেলের পার্শবর্তী একটি মাদরাসায় চাকরি হওয়ায় তিনি ওই কাজ ছেড়ে দিয়েছেন। রাসেল ছেড়ে দেয়ার পর এখন ইমরানের কাজ করছেন মো. রায়হান জজ। যদিও বিষয়টি রায়হান জজ অস্বীকার করেছেন। তবে রায়হান জজের চাচা মো. ইলিয়াস জজ বলেছেন, ‘গত এক বছর ধরে রায়হান ৯৭ নং একরামখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ইমরান খানের বদলে ডিউটি করে আসছে। এখনো বদলি ডিউটি করছে। রায়হানকে প্রতি মাসে ইমরান তিন হাজার টাকা দেয়।’

 

ওই স্কুলের ৩য় শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘আমাদের দপ্তরি তো রায়হান জজ ভাই। ইমরান তো আমাদের দপ্তরি না।’ ৪র্থ শ্রেণির এক শিক্ষার্থী বলেন, ‘রায়হান ভাই আমাদের ঘণ্টা দেয়, সব কাজ সে করে।’

 

চান মিয়া শিকদার নামের এক ব্যক্তি বলেন, আমাদের ছেলে-মেয়ে যখন ভর্তি হয়েছে, তখন দেখছি সব কাজ রায়হান জজ করেছে। রায়হানই তো স্কুলে দায়িত্ব পালন করেন। ইমরান তো বিভিন্ন জায়গায় রাজনীতি করে বেড়ায়।

 

স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি মো. সোহাগ বলেন, ‘আমি যখন সভাপতি ছিলাম, ঝড়-বন্যাসহ বড় ধরনের বিপদ আপদেও ইমরানকে ফোন করলেও স্কুলে না এসে তার বদলে অন্য লোক পাঠিয়ে দিত।’

 

মুঠোফোনে জানতে চাইলে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির বর্তমান সভাপতি মো. জাহিদ বলেন, ‘এ বিষয়ে পরে কথা বলবো।’ এই জাহিদ ইমরানের বোন জামাই। জানা গেছে- তিনি অন্য এলাকার। পেশায় ইলেকটিশিয়ান। ইমরান প্রভাব খাটিয়ে তাকে সভাপতি বানিয়েছেন।

 

ইমরান দাবি করেন, ‘তিনি স্কুলে নিয়মিত দায়িত্ব পালন করেন এবং নিয়মিত হাজিরা খাতায়ও স্বাক্ষর করেন।’ আর ইমরানের বাবা ওই বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মো. ইউসুফ আলী খান বলেন, ‘এসব অনিয়ম আমরা বুঝি। ইউএনওর (উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা) ওপরে আদালত রয়েছে। আদালতের ওপরে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট রয়েছে। আমরা সেখানে বুঝব।’

 

এ বিষয়ে রোববার মুঠোফোনে উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা সজল মহলী বলেন, আমরা তো কোনো ব্যবস্থা নিতে পারি না। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ব্যবস্থা নিতে পারেন। এ বিষয়ে তিনি উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

 

সংশ্লিষ্ট স্কুলের তথ্য বলছে, ২০১৫ সালের মার্চ মাসে মাসিক ৭ হাজার টাকা বেতনে ওই স্কুলে নিয়োগ পান ইমরান। নিজে ডিউটি না করে অন্য লোক পাঠিয়ে বদলি ডিউটি করানো শুরু করেন। ওই বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত ৫ মাসে সরকারি ৩৫ হাজার টাকা ‘অবৈধভাবে’ বেতন গ্রহণ করেন। এত অনিয়মের পরও ২০১৫ সালের আগস্ট মাস থেকে তার মাসিক বেতন বেড়ে ১৪ হাজার ৩০০ টাকা হয়। সে হিসাবে সেই থেকে চলতি বছরের অক্টোবর মাস পর্যন্ত ৮৭ মাসে মোট বেতন উত্তোলন করেন ১২ লাখ ৪৪ হাজার ১০০ টাকা। আর ওই সময়ের মধ্যে ইমরান উৎসব ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতা (বোনাস) উত্তোলন করেছেন ৯৬ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে ‘চাকরি না করেও’ ইমরান হাতিয়ে নিয়েছেন সরকারি মোট ১৩ লাখ ৭৫ হাজার ১০০ টাকা।

 

এ বিষয়ে বাগেরহাট জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মু. শাহ আলম বলেন, ‘সঠিক তদন্ত পূর্বক আইনগত ব্যবস্থাগ্রহণ করা হবে। একই সঙ্গে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধেও বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে।’

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version