-->

ভুল চিকিৎসার মাশুল দিতে হয় রোগীকেই

নিখিল মানখিন
ভুল চিকিৎসার মাশুল দিতে হয় রোগীকেই

ঢাকা: মারামারির ঘটনায় গুরুত্বর আহত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন দুর্গাপুর উপজেলার মো. ইউসুফ। কয়েকদিন থাকার পর সুস্থ ভেবে তাকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু হাসপাতাল থেকে যাওয়ার দুদিন পর তার মৃত্যু হয়। মৃত্যু-পরবর্তী ময়নাতদন্তে আঘাতের কারণে শরীরের ভেতরে প্রচুর রক্তক্ষরণের বিষয়টি ধরা পড়ে, যা হাসপাতালের চিকিৎসকরা শনাক্ত করতে পারেননি। এমন ভুল চিকিৎসার আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর অভিযোগ ও মামলার বিষয়টি বর্তমানে স্বাভাবিক ঘটনায় রূপ নিয়েছে। অভিযোগ তোলার সুযোগ পায় না অনেক অসহায় রোগীর স্বজন। এতে দেশের চিকিৎসাসেবার ওপর সাধারণের আস্থা কমে যাচ্ছে। ভুল চিকিৎসার অভিযোগকে কেন্দ্র করে প্রায়ই চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী বা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে রোগীর স্বজনদের বাদানুবাদ, ভাঙচুর এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার ঘটছে।

 

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, ‘আস্থা’ ধরে রাখতে না পারলে ভবিষ্যতে মারাত্মক সমস্যায় পড়বে দেশের চিকিৎসা সেক্টর। বেড়ে যাবে চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী রোগীর সংখ্যা। চিকিৎসা সেক্টরে অরাজকতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে আশঙ্ক প্রকাশ করেন বিশেষজ্ঞরা।

 

তারা বলেন, চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল বলতে শুধু চিকিৎসকের অবহেলা নয়, বরং চিকিৎসাসেবা সংক্রান্ত আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা; যেমন নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ, ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদন ও সরবরাহকারীদের অবহেলাও বোঝানো হয়। ভুল চিকিৎসা বা চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগ নিষ্পত্তি এবং আইনগত প্রতিকারের জন্য এখনো বাংলাদেশে একক কোনো আইন কার্যকর নেই। বাংলাদেশে ২০১৬ সালে ‘রোগী এবং স্বাস্থ্যসেবা দানকারী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সুরক্ষা আইন’ নামে একটি আইন প্রস্তাব করে সরকার। কিন্তু এ আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি। তবে বিভিন্ন বিক্ষিপ্ত আইনে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে আইনি প্রতিকারের সুযোগ রয়েছে। ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যু ও শারীরিক ক্ষতির শিকার হওয়ার বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে আলোচনা-সমালোচনা। আইনি লড়াইয়ে ভুল চিকিৎসা প্রদান প্রমাণিত হয়ে অভিযুক্তদের জেলে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। দুয়েকদিন পরপর এমন ঘটনার খবর বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার হচ্ছে। এসব খবরে আতঙ্কিত হয়ে চিকিৎসা গ্রহণের আগে বারবার ভাবতে হচ্ছে রোগী ও তাদের স্বজনকে।

 

গত ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় জুয়েল মিয়া নামে এক পোলট্রি ব্যবসায়ীকে ভুল চিকিৎসায় মৃত্যুর মামলায় ২ চিকিৎসকসহ তিনজনকে ২ বছর করে কারাদণ্ড দেন আদালত। এছাড়া ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা এবং অনাদায়ে আরো এক বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়।

 

মামলার এজাহার ও নিহতের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ৫ জুলাই পোলট্রি ব্যবসায়ী জুয়েল মিয়া ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে ট্রমা হাসপাতালের অর্থোপেডিক চিকিৎসক ডা. কামরুজ্জামানের তত্ত্বাবধানে হাতের অস্ত্রোপচার করতে হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে অ্যানেস্থেসিয়া (অজ্ঞান) চিকিৎসক না থাকায় হাসপাতালের সহকারী গৌরাঙ্গ সাহা রোগীকে অ্যানেস্থেসিয়ারর ওষুধ প্রয়োগ করেন। পরে অস্ত্রোপচার করার পর রোগীর জ্ঞান না ফেরায় অপারেশন থিয়েটারেই রোগীর মৃত্যু হয়। কিন্তু রোগীর জ্ঞান ফিরে না আসায় সন্দেহ হলে স্বজনরা রোগীর কাছে যেতে চাইলে তাদের অপারেশন থিয়েটারে যেতে না দিয়ে মৃত রোগীকে জীবিত আছে বলে দ্রুত ঢাকায় নিয়ে যেতে বলেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পরে রোগীর স্বজনরা অপারেশন থিয়েটারে জোর করে ঢুকে দেখেন রোগী মারা গেছেন।

 

২০২২ সালের জানুয়ারিতে মানিকগঞ্জ পৌরসভার জয়নগর এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভুল চিকিৎসায় সাগর খান নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যুর অভিযোগ ওঠে। পরে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আইনি ঝামেলা এড়াতে ৪ লাখ টাকায় মৃতের পরিবারের সঙ্গে সমঝোতা করে। ওইসময় নিহতের বাবা হারুন খান জানান, সাগরের পেটে ব্যথা হলে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

 

সেখানে দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, সাগরের অ্যাপেন্ডিসাইটিস হয়েছে। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী সাগরকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এবং সন্ধ্যায় তার অস্ত্রোপচার করা হয়। তাদের না জানিয়েই সাগরকে সাভারের আরেকটি বেসরকারি অইসিইউতে ভর্তি করা হয়। সেখানে তাকে মৃত ঘোষণা করে সুপার মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। সাগর সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে তাকে মেরে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাগরের বাবা। নেত্রনালি অস্ত্রোপচার না করে চোখের ছানি অপারেশন করে কৃত্রিম ল্যান্স লাগিয়ে দেয়ায় চট্টগ্রামের লায়ন্স হাসপাতালের এক চিকিৎসকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি খুলশী থানায় ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীর ভাই আবুল হোসেন আকাশ বাদী হয়ে এ মামলা করেন। ভুল চিকিৎসার শিকার রোগীর নাম হালিমা। তার বাসা নগরের দেওয়ানহাট এলাকায় এবং গ্রামের বাড়ি চাঁদপুরে।

 

মামলার এজহারে বলা হয়, ২০২১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নেত্রনালির সমস্যা নিয়ে লায়ন্স চক্ষু হাসপাতালের চিকিৎসক ফারহানা আফরোজের শরণাপন্ন হন হালিমা। প্রাথমিক চিকিৎসার পর ডাক্তার আফরোজা রোগীকে নেত্রনালি অস্ত্রোপচার করতে হবে জানিয়ে অভিযুক্ত চিকিৎসক মিজানুল হকের কাছে পাঠান। ২০২২ সালের ৮ জানুয়ারি হালিমার নেত্রনালির অস্ত্রোপচারের পরিবর্তে চোখের ছানির অস্ত্রোপচার করেন অভিযুক্ত চিকিৎসক।

 

ভুল চিকিৎসার শিকার সুবল সরকার তুলে ধরেন তার দুঃসহ যন্ত্রণার কথা। তিনি বলেন, আমার পাইলসের সমস্যা ছিল। চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে তিনি অপারেশনের (অস্ত্রোপচার) পরামর্শ দেন। এর বিকল্প নেই বলে জানান চিকিৎসক। তার পরামর্শ অনুযায়ী অপারেশনও করা হয়। রাতে যখন জ্ঞান ফেরে, তখন প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করি। নার্সরা এসে শক্ত করে ধরে রাখেন। মনে হয়েছে, ভেতরে গজ কিংবা সুতাজাতীয় কিছু রয়ে গেছে। বিষয়টি চিকিৎসকদের জানানো হয়। পরদিন সকাল ১০টার দিকে হাসপাতাল থেকে বাসায় চলে যাই। বিকেলের দিকে আবার ব্যথা শুরু হয়। চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। অনেক চাপাচাপি করার পর এক্স-রে করতে বলেন। আরেকটি হাসপাতালে এক্স-রে করি। রিপোর্ট নিয়ে যখন ওই চিকিৎসকের কাছে যাই, তখন বলা হয় ভেতর সুতা রয়ে গেছে। কিন্তু আমাকে অন্য চিকিৎসক বললেন একটি সুঁই রয়ে গেছে। আরো একবার অপারেশন করা হয়, কিন্তু সুঁই বের করতে পারেননি। পরে দেশের বাইরে চলে যাই। সেখানে চিকিৎসকেরা খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণ করেন। কয়েকজন চিকিৎসক মিলে ২-৩ ঘণ্টা অপারেশন করে শরীর থেকে সুঁইটি অপসারণ করেন বলে জানান সুবল সরকার। এভাবে ভুল চিকিৎসার ঘটনা এবং ভুল চিকিৎসার অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন মিডিয়ায় প্রকাশ ও প্রচার হচ্ছে।

 

চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক জিল্লুর রহমান বলেন, চিকিৎসাক্ষেত্রে কিছু জটিলতা থাকে। আমাদের দেশে জটিলতা যেমন আছে, তেমনি উন্নত দেশেও কিছু কিছু জটিলতা হয়। ভুল ডায়াগনসিসও হয়ে থাকে। হয়তো আমাদের এখানে একটু বেশি। তাছাড়া আমাদের চিকিৎসকদের অধিকসংখ্যক রোগীকে সামলাতে হয়। রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদের দেশ হয়তো উন্নত দেশের তুলনায় ৫০ বছর পেছনে। বিশ্বে এখন নতুন নতুন পদ্ধতিতে রোগ নির্ণয় হচ্ছে। আস্তে আস্তে আমরাও উন্নত রোগ নির্ণয় ব্যবস্থার দিকে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে আমাদের বিনিয়োগ একটা প্রধান ঘাটতি।

 

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসকের কাছ থেকে রোগীদের সঠিক চিকিৎসা পাওয়ার অধিকার আছে। যদি তারা সঠিক চিকিৎসা না পায়, তাহলে বিএমডিসিতে অভিযোগের সুযোগ রয়েছে। অভিযোগগুলো একটি শৃঙ্খলা কমিটির মাধ্যমে তদন্ত করে সমাধান করা হয়।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের সাবেক ডিন ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ ভোরের আকাশকে বলেন, চিকিৎসাশাস্ত্র একটি স্পর্শকাতর ক্ষেত্র। চিকিৎসাসেবা প্রদানের ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে না, এমন কথা বলতে পারব না। তবে প্রকৃত চিকিৎসক, নার্স এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ইচ্ছাকৃতভাবে চিকিৎসাসেবা প্রদানে ভুল করেন না। কিছুসংখ্যক অসাধু চিকিৎসক, নার্স, টেকনিসিয়ান, স্বাস্থ্যকর্মী আছেন যারা ব্যবসায়িক স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন। তাদের দ্বারা রোগীর ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version