-->

উন্নয়ন অভিযাত্রায় স্মার্ট বাজেট

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
উন্নয়ন অভিযাত্রায় স্মার্ট বাজেট

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ‘উন্নয়নের দীর্ঘ অগ্রযাত্রা পেরিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশের অভিমুখে’ এ শিরোনামে বাংলাদেশের ৫২তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৪তম বাজেট পেশ জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করা হয়েছে। অন্য যেকোনো বারের চেয়ে এবার বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে পেশ করা হয়েছে বৃহত্তম এবং জনবান্ধব এ বাজেট। গতকাল বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বিকেল ৩টায় নতুন ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এবারের বাজেটে ঘাটতি রয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা। ডিজিটাল বাংলাদেশের আরেক ধাপ ওপরে হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ। বর্তমানে নানারকম সংকটের মধ্যেও স্মার্ট বাংলাদেশ ভিশন-২০৪১-এর স্বপ্ন দেখাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। মূলত এ লক্ষ্য নিয়েই বাজেট পেশ করেন অর্থমন্ত্রী। উচ্চ প্রবৃদ্ধির প্রত্যাশা নিয়ে ৭.৫ শতাংশ জিডিপি প্রাক্কলন করা হয়েছে এবারের বাজেটে। একইভাবে বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬.৫ শতাংশ।

 

সংশ্লিষ্টদের মতে, বাজেট জনবান্ধব হলেও নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ থাকবে প্রধান চ্যালেঞ্জ। সুদ ব্যয়, ভর্তুকি ছাড়াও রাজস্ব আদায় বাড়ানো, আইএমএফসহ উন্নয়ন সহযোগীদের দেয়া বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়ন ও উচ্চ প্রবৃদ্ধি বজায় রাখা এবারের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে থাকছে। এগুলো মোকাবিলা ও সমন্বয় করে নির্বাচনের বছরে কীভাবে ব্যয় সমন্বয় করা যাবে, তা মাথায় রেখেই বাজেট তৈরি হয়েছে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের তুলনায় নতুন অর্থবছরের বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ১২ শতাংশ বেশি। সর্বশেষ ২০২২ সালের ৯ জুন অর্থমন্ত্রী ২০২৩ সালের ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্য ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭২ সালের ৩০ জুন একইসঙ্গে ১৯৭১-৭২ ও ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। আর এ বছর নতুন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল দেশের ৫২তম বাজেট উপস্থাপন করেছেন।

 

ঘাটতি বাজেট কী : কোনো আর্থিক বছরে সরকারের প্রত্যাশিত আয় অপেক্ষা ব্যয়ের পরিমাণ বেশি হলে তাকে ঘাটতি বাজেট বলে। সরকার বাজেটের এ ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে জনসাধারণের কাছ থেকে ঋণ, নতুন অর্থ সৃষ্টি, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ, বৈদেশিক ঋণ ও অনুদান গ্রহণ করে। বাজেট ঘাটতি দুইভাবে পূরণ করা হয়।বৈদেশিক উৎস : এটি মূলত বৈদেশিক ঋণ। সরকার বিভিন্ন দাতা সংস্থা ও দেশ থেকে সহজ শর্তে ঋণ নেয়।

 

অভ্যন্তরীণ উৎস : সরকার দুইভাবে দেশের ভেতর থেকে ঋণ নেয়। যেমন ব্যাংকিং ব্যবস্থা ও ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা। ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা হচ্ছে সঞ্চয়পত্র বিক্রি। এভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ঋণ নেয় সরকার। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে বেশি ঋণ নেয়ার দুটি বিপদ আছে। ব্যাংকিং ব্যবস্থা থেকে সরকার বেশি ঋণ নিলে বেসরকারি খাতের জন্য অর্থ থাকবে কম। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। আর ব্যাংকবহির্ভূত ব্যবস্থা থেকে ঋণ নিলে বেশি হারে সুদ দিতে হয়। এতে সুদ পরিশোধে সরকারকে বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখতে হয়।

 

বাংলাদেশ কেন ঘাটতি বাজেট করে : উন্নয়নশীল দেশগুলো সাধারণত ঘাটতি বাজেটই প্রণয়ন করে। বাংলাদেশও শুরু থেকেই ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করেছে। উন্নয়নশীল দেশে প্রাকৃতিক সম্পদের পরিপূর্ণ ব্যবহার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, মাথাপিছু আয় বৃদ্ধি ও জনগণের জীবনযাত্রার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে কিছুটা ঘাটতি বাজেট প্রণয়ন করতে হয়। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশে কিছুটা ঘাটতি থাকা ভালো। এতে অব্যবহৃত সম্পদের ব্যবহার বাড়ে, ঘাটতি পূরণের চাপ থাকে। তাতে অর্থনীতিতে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তবে ঘাটতি বেশি থাকাটা আবার ভালো নয়।

 

যেভাবে পূরণ হবে ঘাটতি বাজেট : প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি পূরণ (অর্থসংস্থান) করা হবে দুইভাবে। বৈদেশিক ঋণ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে। বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে নিট ১ লাখ ২ হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। আর অভ্যন্তরীণ ঋণ নেয়া হবে ১ লাখ ৫৫ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা। অভ্যন্তরীণ ঋণের মধ্যে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেয়া হবে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা, আর সঞ্চয়পত্র বিক্রিসহ ব্যাংকবহির্ভূত ঋণ নেয়া হবে ২৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার তুলনায় আগামী অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে সরকার ২৬ হাজার বা ২৪ শতাংশ বেশি ঋণ নেবে, যা মূল্যস্ফীতি বাড়াতে পারে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বেশি ব্যাংকঋণ মানে বেশি টাকা ছাপানো। আর বেশি টাকা ছাপানো মানে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধির আশঙ্কা। সরকার বেশি ব্যাংকঋণ নিলে বেসরকারি খাতের ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা কমে যায় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।

 

রাজস্ব আয় : বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী জানান, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মোট রাজস্ব আয় প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ লাখ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে ৪ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস হতে ৭০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার প্রস্তাব করছি। তিনি আরো বলেন, আগামী ২০২৩-২৪ অর্থ বাজেটের আকার প্রাক্কলন করা হয়েছে ৭ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ১৫.২ শতাংশ। পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৪ লাখ ৩৬ হাজার ২৪৭ কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করছি। নতুন এডিপি চলতি অর্থবছরের সংশোধিত এডিপির তুলনায় প্রায় ১৬ শতাংশ বেশি এবং মূল এডিপির তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও দেশের সম্পদ, বৈদেশিক অর্থায়ন ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের এডিপি প্রণয়ন করা হয়েছে।

 

এদিকে সার্বিকভাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারের সুদ ব্যয়ে বরাদ্দ থাকছে ১ লাখ ২ হাজার কোটি টাকা। একইভাবে বিপুল ভর্তুকির মধ্যে বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরের বাজেটে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল, পরে সংশোধিত বাজেটে তা বাড়িয়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা করা হয়। আগামী অর্থবছরে কৃষি খাতে ভর্তুকিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে যা ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। এদিকে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। সরকারের শেষ বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নতুন করে ৭ লাখ ৩৫ হাজার জন বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীকে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয়।

 

অন্যদিকে নতুন অর্থবছর ২০২৩-২৪ বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। তবে চলমান উচ্চমূল্যস্ফীতি ও বিশ্ব পরিস্থিতি বিবেচনায় আদৌ সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে মূল্যস্ফীতিকে ধরে রাখা সম্ভব কিনাÑ এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে পর্যুদস্ত সারা বিশ্ব। বিশেষ করে এর প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে। ইউরোপের বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশের বাসিন্দারা নিত্যপণ্যের দাম মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় দেখা দিয়েছে সংকট, বেড়ে গেছে জাহাজ ভাড়া; আর এর প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের বাজারেও। সেই হিসাবে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version