-->

কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ল ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক
কৃষি উন্নয়নে বরাদ্দ বাড়ল ১ হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা

প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এসব পরিকবল্পনা বাস্তবায়নে এই খাতে এবার বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী তার বাজেট বক্তৃতায় বলেন, সরকারের সময়োপযোগী পদক্ষেপের ফলে চলমান বৈশ্বিক সংকটের মাঝেও কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত আছে। কৃষিবান্ধব নীতির প্রভাবে ধান, ভুট্টা, আলু, সবজি ও ফলসহ অন্যান্য ফসল উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশ বিশ্বে চাল উৎপাদনে তৃতীয়, পাট উৎপাদনে দ্বিতীয়, চা উৎপাদনে চতুর্থ, ইলিশ উৎপাদনে প্রথম, মাছ উৎপাদনে দ্বিতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, পেঁয়াজ উৎপাদনে তৃতীয়, আলু ও আম উৎপাদনে সপ্তম, ছাগল উৎপাদনে চতুর্থ ও ছাগলের মাংস উৎপাদনে সপ্তম অবস্থানে রয়েছে। এ অবস্থায় এই সেক্টরের আরো উন্নয়নে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়নে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কৃষি খাতে এক হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তিনি বলেন, নতুন অর্থবছরে এই খাতে বরাদ্দ থাকছে ৩৫ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ ছিল ৩৩ হাজার ৬৯৮ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে এ বছরের বরাদ্দ এক হাজার ৬৭৬ কোটি টাকা বেশি।

 

বাজেট বক্তৃতায় কৃষি উন্নয়নে নানা পদক্ষেপের বিষয় উল্লেখ করে কৃষিমন্ত্রী জানান, ফসলের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য সরকার সাশ্রয়ী মূল্যে সার, বীজ ও অন্যান্য উপকরণ এবং সেচ সুবিধা প্রদান করছে। কৃষকদের কাছে সাশ্রয়ী মূল্যে প্রয়োজনমতো সার সরবরাহের জন্য সরকার ভর্তুকি দিচ্ছে। সেচকাজে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত প্রদান করা হচ্ছে। উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের জন্য হাওর ও উপকূলীয় এলাকায় ৭০ শতাংশ ও অন্যান্য এলাকায় ৫০ শতাংশ উন্নয়ন সহায়তায় ৫১ হাজার ৩০০টি কৃষি যন্ত্রপাতি সরবরাহের কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়েছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণের সুবিধা ব্যবহার করে ধানের চারা তৈরি, রোপণ ও কর্তনের জন্য সমলয়ে চাষাবাদ পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয়েছে। বোরো মৌসুমে দীর্ঘ জীবনকালীন ধানের পরিবর্তে স্বল্প জীবনকালীন ধান আবাদের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

 

তিনি বলেন, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে পতিত ও অব্যবহৃত জমিতে চাষাবাদ শুরু হয়েছে। পেঁয়াজ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, ভোজ্যতেলের আমদানি হ্রাস, আলু রপ্তানি বৃদ্ধি, কাজুবাদাম, কফিসহ রপ্তানিমুখী ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। খাদ্যশস্যের পাশাপাশি আম, পেয়ারা, কুল, কলা, পেঁপেসহ বিভিন্ন উদ্যানভিত্তিক ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা হচ্ছে। পারিবারিক পুষ্টি বাগান প্রকল্পের আওতায় প্রতিটি ইউনিয়নে ১০০টি করে মোট ৪ লক্ষ ৮৮ হাজার ৪০০টি পারিবারিক সবজি বাগান স্থাপনের কাজ চলছে। ইতোমধ্যে ২ লক্ষ ৫২ হাজার ৯৬টি বাগান স্থাপিত হয়েছে।

 

কৃষি উপকরণ সহায়তা কার্ডের মাধ্যমে কৃষকদের কৃষি উপকরণ ও ঋণ সহায়তা প্রদান করা হচ্ছে। কার্ডধারী কৃষকের সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ২ কোটিতে উন্নীত হয়েছে। সব কৃষককে স্মার্ট কার্ড প্রদানের জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়, পাহাড়ি ঢলসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নিতে কৃষকদের ভর্তুকির পাশপাশি প্রণোদনা ও পুনর্বাসন সুবিধা দেয়া হচ্ছে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণ ও উন্নত প্যাকেজিং ব্যবস্থার মাধ্যমে ফসল সংগ্রহোত্তর ক্ষতি কমিয়ে আনা হচ্ছে। সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আধুনিক সংরক্ষণাগার, প্যাকেজিং হাউস, কুল চেইনসহ অন্যান্য সুবিধা স্থাপনকে উৎসাহিত করা হয়েছে। কৃষিপণ্য রপ্তানি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় প্যাকিং হাউসে স্থাপিত উদ্ভিদ সংঘনিরোধ ল্যাবরেটরিকে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ৭০টির বেশি সবজি ও ফল বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। কৃষিপণ্য রপ্তানিতে ইতোমধ্যে ১০০ কোটি ডলার আয়ের মাইলফলক অতিক্রম করেছে সরকার।

 

তিনি বলেন, কৃষি খাতে গবেষণার মাধ্যমে বিগত ১৪ বছরে বৈরী পরিবেশ সহনশীল জাতসহ মোট ৬৯০টি উন্নত-উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল উদ্ভাবন করা সম্ভব হয়েছে। উত্তম কৃষি চর্চার মাধ্যমে ১ হাজার সবজি উৎপাদন গ্রাম প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কৃষি গবেষণা কাউন্সিল ক্রোপ জোনিং ওয়েবসাইট ও খামারি মোবাইল অ্যাপ চালু করেছে। ৩০০টি উপজেলায় ৭৬টি ফসলের ক্রপ জোনিং কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘কৃষি খাত উন্নয়নে সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ২০২২’ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা-সহিষ্ণু ধানের চাষ করছে। ভাসমান কৃষি, ছাদ কৃষি, হাইড্রোপনিক ও অ্যারোপনিক কৃষি, সমুদ্র সম্ভাবনা ও প্রিসিশন কৃষি কার্যক্রমকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। সরকার ‘স্মার্ট কৃষিকার্ড ও ডিজিটাল কৃষি (পাইলট) প্রকল্প (২০২২-২৬)’ ও ‘ক্লাইমেট স্মার্ট এগ্রিকালচার অ্যান্ড ওয়াটার ম্যানেজমেন্ট’ প্রকল্প (২০২২-২৫) বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। কৃষি কমিউনিটি রেডিও, কৃষক বন্ধু ফোন-৩৩৩১, ই-বুক, অনলাইন সার সুপারিশ, ই-সেচ সেবা, রাইস নলেজ ব্যাংক, কৃষি প্রযুক্তি ভান্ডার, ই-বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষকের জানালা, কৃষকের ডিজিটাল ঠিকানা, কমিউনিটি রুরাল রেডিওসহ বিভিন্ন মোবাইল এবং ওয়েব অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে কৃষকদের দোরগোড়ায় কৃষিতথ্য সেবা পৌঁছে দেয়া। অনলাইন কৃষি মার্কেটিং প্ল্যাটফর্ম ‘হর্টেক্স বাজার’ এবং ‘ফুড ফর নেশন’ চালু করা হয়েছে।

 

বাজেট বক্তৃতায় তিনি আরো উল্লেখ করেন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার অন্যতম অনুষঙ্গ হলো- উন্নত সংরক্ষণ ব্যবস্থা। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী খাদ্যশস্য সংরক্ষণ ক্ষমতা বিদ্যমান ২১.৮ লক্ষ টন হতে ২০২৫ সালের মধ্যে ৩৭ লক্ষ টনে উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে সরকার কাজ করছে। সারা দেশে পুরাতন খাদ্য গুদাম ও আনুষঙ্গিক সুবিধাদির মেরামত এবং নতুন অবকাঠামো নির্মাণ, খাদ্যশস্যের পুষ্টিমান নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রিমিক্স কার্নেল মেশিন ও ল্যাবরেটরি স্থাপন এবং বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। দরিদ্র, অনগ্রসর, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকার জনগোষ্ঠীর নিরাপদ খাদ্য সংরক্ষণের জন্য ৫৫টি উপজেলায় ৩ লক্ষ পরিবারের মধ্যে পারিবারিক সাইলো বিতরণ করা হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তা তদারকির কাজ জোরদার করার জন্য আমরা ৬৪টি জেলায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের অফিস স্থাপন করেছি এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে খাদ্যের মজুদ, সংরক্ষণ, ও বাজার মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করছি।

 

তিনি বলেন, কর্মাভাবকালীন ৫ মাসে ১৫ টাকা কেজি দরে প্রতিমাসে ৩০ কেজি চাল বিতরণ করা হয়। এছাড়া, স্বল্পআয়ের মানুষদের জন্য খাদ্য প্রাপ্তি সহজ করার উদ্দেশ্যে খোলাবাজারে চাল-আটাসহ বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী বিক্রয় করা হচ্ছে। বিভিন্ন উপজেলায় পুষ্টি চাল বিতরণের কাজ চলমান আছে। স্বচ্ছতা ও দ্রুততার স্বার্থে খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি ডিজিটাইজড করা হচ্ছে।

 

অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়, বদ্ধ জলাশয় ও সম্প্রসারিত সামুদ্রিক জলাশয়ের উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার জন্য সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশ মাছ উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। ‘গভীর সমুদ্রে টুনা ও সমজাতীয় পেলাজিক মাছ আহরণে পাইলট প্রকল্প’ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। সামুদ্রিক মাছের প্রজনন ও সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছর ২০ মে হতে ২৩ জুলাই পর্যন্ত (মোট ৬৫ দিন) দেশের অর্থনৈতিক জলসীমায় সব ধরনের মাছ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিষিদ্ধ সময়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি জেলে পরিবারকে মাসে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে ‘সামুদ্রিক মৎস্য বিধিমালা ২০২৩’-এর গেজেট প্রকাশ করা। বঙ্গোপসাগরে জরিপ পরিচালনা করে ৪২৬ প্রজাতির মাছের একটি পূর্ণাঙ্গ ক্যাটালগ এবং সমুদ্র উপকূলে ১৫৪ উপজাতির সি-উইড শনাক্ত করা হয়েছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের বিলুপ্তি রোধ ও প্রাচুর্য রক্ষার জন্য দেশের বিভিন্ন নদ-নদী ও অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে ৪৩২টি অভয়াশ্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। প্রাকৃতিক জলাশয়ে আহরণযোগ্য মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য নির্বাচিত জলাশয়ে বিল নার্সারি স্থাপনের কাজ চলছে। দেশের সব পতিত জলাশয়কে মাছ চাষের আওতায় নিয়ে আসছি। দেশীয় মাছ সংরক্ষণে ২০২০ সালে প্রথম লাইভ জীন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে এবং এ ব্যাংকে ১০২ প্রজাতির দেশীয় মাছ সংরক্ষণ করা হয়েছে।

 

তিনি বলেন, কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বিলুপ্তপ্রায় মাছ সংরক্ষণ, কৌলিতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে মাছের জাত উন্নয়ন, ম্যালিকুলার বায়োলজি ব্যবহার করে বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ মাছের ভ্যাকসিন উদ্ভাবন, স্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করে হ্যাচারি ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, সামুদ্রিক মৎস্যসম্পদ আহরণ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ আধুনিকায়নের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে। গবাদিপশু এবং হাঁস-মুরগির টেকসই জাত উন্নয়ন এবং রোগ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে স্মার্ট লাইভস্টক সেক্টর গঠন ও উৎপাদন দ্বিগুণ করার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারের ধারাবাহিক প্রচেষ্টায় মাংস ও ডিম উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। দুধ উৎপাদনে আশাব্যঞ্জক অগ্রগতি হয়েছে। কোরবানির পশুর বাজার স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে, দেশীয় উৎস থেকে কোরবানির পশুর চাহিদা পূরণ হচ্ছে। খামারির দোরগোড়ায় জরুরি ভেটেরিনারি চিকিৎসা সেবা প্রদানের জন্য ৩৬০টি মোবাইল ভেটেরিনারি ক্লিনিক চালু করা হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমাদের লক্ষ্য হলো- দেশজ উৎপাদিত দুধের দৈনিক মাথাপিছু প্রাপ্যতা ২৩৬ গ্রাম-এ উন্নীত করা, গবাদিপশুর জাত উন্নয়ন ও সংরক্ষণে ৪৬ লক্ষ মাত্রা সিমেন উৎপাদন করে দেশব্যাপী ৪২ লক্ষ গাভি/বকনাকে কৃত্রিম প্রজনন করানো, সরকারি পোলট্রি খামারে ৪১ লক্ষ ৫০ হাজার মুরগির বাচ্চা উৎপাদন ও ভর্তুকি মূল্যে বিতরণ করা।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version