দেশের অর্থনীতিতে কাটিয়ে উঠছে মন্দার প্রভাব। চলমান ডলার সংকট আস্তে আস্তে প্রশমিত হতে শুরু করেছে। রেমিট্যান্স, রপ্তানি আয়সহ বেশকিছু সূচক ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হচ্ছে। নানা কারণে খুব হিসাব-নিকাশ করে ডলার খরচ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তার দাবি, রিজার্ভ নিয়ে তারা কোনো দুশ্চিন্তা করছেন না। আগামী জুন পর্যন্ত যাতে রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক থাকে, সেভাবেই এখন ডলার খরচ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, জুন মাস নাগাদ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৭.৫০ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। এছাড়া জুন মাসে রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ বেড়ে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। এ অর্থবছরে আমদানি ব্যয় ৮০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে পারে। তবে ডলার সংকটের সমাধান রাতারাতি হবে না।
রপ্তানিকারকরা বলছেন, তৈরি পোশাক শিল্পের পাশাপাশি ইস্পাত, সিমেন্ট, টেক্সটাইল, এমনকি ওষুধ প্রস্তুতকারকরাও কাঁচামালের জন্য এলসি খুলতে পারছেন না। ধারণা করা যাচ্ছে, আগামী কয়েক মাস এ পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাংলাদেশে ডলার সংকটের অন্যতম কারণ হলো দেশের অতিরিক্ত আমদানিনির্ভরতা এবং স্থানীয় পর্যায়ে কাঁচামাল ও পণ্য উৎপাদন না হওয়া। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়েছে। মূলত খাদ্যশস্য থেকে শুরু করে বাংলাদেশকে চিনি, ভোজ্যতেল, মসলা, পেট্রোলিয়াম পণ্য, সার, তুলা, সুতা, রাসায়নিক, শিল্পের যন্ত্রপাতি, সিমেন্ট ও ইস্পাত কারখানার কাঁচামালসহ প্রায় সব পণ্যই আমদানি করতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, দেশে এখন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে। এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) কাছে আমদানির দায় হিসেবে রিজার্ভ থেকে ১০৫ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর ফলে (১৫ মার্চ) রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.২৮ বিলিয়ন ডলারে। এ রিজার্ভ দিয়ে প্রায় চার মাসের (প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন হিসাবে) আমদানি ব্যয় মেটানো যাবে।
যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) আন্তর্জাতিক মানদন্ডের আলোকে হিসাব করলে রিজার্ভ এখন ২৩ বিলিয়নের কিছু বেশি। এ অবস্থার মধ্যেও আইএমএফের পূর্বাভাস বলছে, আগামী অর্থবছর থেকে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ বাড়বে। আর ২০২৬-২৭ অর্থবছর শেষে দেশের রিজার্ভ প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার বা ৫ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। অর্থনীতিবিদরাও বলছেন বৈশ্বিক বাস্তবতায় এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের অর্থনীতি সঠিক পথেই আছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমি আশাবাদী ধীরে ধীরে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। সামনে দুটি ঈদ আছে। কয়দিন পর শুরু হচ্ছে রমজান মাস। এ রমজান ও ঈদ উপলক্ষে প্রবাসীরা বেশি বেশি রেমিট্যান্স পাঠাবেন। রমজানের পর কোরবানির ঈদেও প্রবাসীরা বেশি করে রেমিট্যান্স পাঠিয়ে থাকেন।
পাশাপাশি রপ্তানিতেও ইতিবাচক ধারা অব্যাহত আছে। বিদেশি ঋণের বড় কিস্তি পরিশোধ যদি না থাকে, তাহলে জুন পর্যন্ত রিজার্ভ থাকবে স্বস্তিদায়ক।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, নিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থার কারণে আমদানি কমছে। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ মাসে ৩ হাজার ৭০৭ কোটি ডলারের রপ্তানি আয় হয়েছে, যা প্রতি মাসে গড়ে ৪৬৩ কোটি ডলার।
নভেম্বর, ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে গড়ে ৫২০ কোটি ডলার রপ্তানি হয়েছে। একই সময়ে বেড়েছে রেমিট্যান্স। ফেব্রুয়ারিতে প্রবাসী আয় বেড়েছে, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২২ কোটি ডলার বেশি। গত মাসে দেশে এসেছে ১৫৬ কোটি ডলার। আগের মাস জানুয়ারিতে এসেছিল ১৯৬ কোটি ডলার। ডিসেম্বরে এটি ছিল প্রায় ১৭০ কোটি ডলার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) যাতে বৈধ পথে দেশে আসে, তা নিশ্চিত করতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে প্রবাসী আয়ে গতি বেড়েছে। সামনে রোজা ও দুটি ঈদ থাকায় রেমিট্যান্সের এ ধারা চলতি মার্চ ও এপ্রিলে অব্যাহত থাকবে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা। গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সরবরাহ চেইন বিঘিত্ন হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পণ্যমূল্যও বেড়ে যায়।
২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের আমদানি বিল ৮২.৪৯ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে, যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৬ শতাংশ বেশি। যদিও চলতি অর্থবছরে আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। গত অর্থবছরে যেখানে মাসে গড়ে ৭ বিলিয়ন ডলার আমদানি বিল আসত, এ বছর তা কমে মাসে ৬ বিলিয়ন ডলার আসছে।
আমদানি কমাতে শতভাগ পর্যন্ত এলসি মার্জিন, বিলাসীপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপসহ বিভিন্ন উদ্যোগের মধ্যে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬ মাসে আমদানি ব্যয় ২.১৫ শতাংশ কমে ৩ হাজার ৮১৩ কোটি ডলারে নেমেছে। এসবকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন অর্থনীতিবিদরা। আর ব্যাংকারদের বক্তব্য হলো কয়েক মাস আগে খোলা এলসিগুলোর বিপরীতে অর্থপ্রদানের বাধ্যবাধকতার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর এখনো চাপ আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, আগামী জুন পর্যন্ত বিদেশি ঋণের বিপরীতে বড় কোনো কিস্তি পরিশোধ নেই। ফলে আগামী মে মাস পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ ধীরে ধীরে বাড়বে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের আশা, এপ্রিল শেষে রিজার্ভ ৩১ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৩২ বিলিয়নে দাঁড়াবে।
তবে আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে রিজার্ভ থেকে আকু পেমেন্ট বা এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (এসিইউ) কাছে প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলারের মতো আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। এতে আগামী মে মাস পর্যন্ত রিজার্ভ ৩২ বিলিয়ন ডলারের ঘরেই থাকবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান বলেন, ‘বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন যে অবস্থায় আছে মার্চ শেষে প্রায় সেই অবস্থায়ই থাকবে। এপ্রিলে একটু বাড়তে পারে। তবে মে মাসে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের কাছে আমদানি বিল পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে এখন রিজার্ভ একটু একটু বাড়লেও মে শেষে ৩২ বিলিয়ন ডলারের আশপাশেই থাকবে।
এ বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে দুশ্চিন্তা নেই। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব মিলিয়ে ২৭৮ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। এর মধ্যে অর্থবছরের প্রথম ৬ মাসে ১১২ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে আরো ৮৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে। বাকি ৮৩ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হবে এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে।
২০১৬-১৭ অর্থবছরে মাত্র ১১৭ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছিল সরকারকে। এরপর প্রতি বছরই তা বেড়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল ২০১ কোটি ডলার। তার মধ্য দিয়ে গত অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বার্ষিক ঋণ পরিশোধ ২০০ কোটি ডলার ছাড়ায়। বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে নেয়া ঋণ পরিশোধ করতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে লাগবে ৪০২ কোটি ডলার।
২০২৯-৩০ অর্থবছরে ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ ৫১৫ কোটি ডলার খরচ হবে। রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেয়া কঠিন শর্তের ঋণগুলোই বেশি ভোগাবে। গত এক দশকে এ তিন দেশের কাছ থেকে সব মিলিয়ে ৩ হাজার ৬২৮ কোটি ডলার ঋণ নেয়ার চুক্তি হয়েছে।
বর্তমান বাজারদরে টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ সাড়ে তিন লাখ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে চীনের ১২ প্রকল্পে ১ হাজার ৭৫৪ কোটি ডলার, রাশিয়া রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার এবং ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটে (এলওসি) ৭৩৬ কোটি ডলার দিচ্ছে। যদিও বিশ^ব্যাংক, এডিবির ঋণ পরিশোধের জন্য সময় পাওয়া যায় ৩২ থেকে ৩৫ বছর।
কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের পর চীন ও ভারতের ঋণ পরিশোধ করতে হবে ১৫ থেকে ২০ বছরে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। এ বছর শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। আর ২০২৪ সাল শেষে এর পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে।
গত বছরের জুন শেষে সরকারি-বেসরকারি খাত মিলিয়ে বিদেশি ঋণের পরিমাণ ৯৫.৮৫ বিলিয়ন (৯ হাজার ৫৮৫ কোটি) ডলার ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান বিনিময়হার অনুযায়ী বিপুল অঙ্কের এ ঋণের ৭৩ শতাংশ সরকারের। বাকি ২৭ শতাংশ ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য