-->

সুবিধা দিতে গিয়ে খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়েছে ব্যাংক

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ
সুবিধা দিতে গিয়ে খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়েছে ব্যাংক

মুস্তাফিজুর রহমান নাহিদ: ঋণগ্রহীতাদের সুবিধা দিতে গিয়েই খেলাপি ঋণের ফাঁদে পড়েছে ব্যাংকগুলো। করোনাকালীন খেলাপি ঋণে বড় ধরনের ছাড় দেয়া হয়। এর পর দফায় দফায় কিছু ছাড় দিয়ে বেকায়দায় পড়েছে ঋণদাতা ব্যাংক। দিন দিন যার পরিমাণ বাড়ছেই।

 

২০২০ সালে করোনাভাইরাসের তান্ডবে বিশ্বের অর্থনেতিক অবস্থা থমকে যায়। পৃথিবীর সব দেশকে এই ভয়াল অবস্থার মোকাবিলা করতে হয়। যার প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশকেও যা মোকাবিলা করতে হয়। এর জের ধরে খেলাপি ঋণের সুবিধা দেয়া হয়। এরপরও ঋণ শোধ করতে না পারায় আরো কয়েক দয়া সুবিধা পান গ্রহীতারা। এভাবেই বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ।

 

প্রাপ্ত তথ্যমতে, করোনার কারণে ২০২০ সালজুড়ে কোনো টাকা পরিশোধ না করলেও গ্রাহকদের খেলাপি করা যাবে না এমন সুবিধা দেয়া হয়। পরে ২০২১ সালে বিশেষ সুবিধার নতুন নির্দেশনা দেয়া হয়। বলা হয়, বছরের শেষ কর্মদিবসের মধ্যে ঋণের ২৫ শতাংশ পরিশোধ করলেই খেলাপি হবেন না গ্রাহক। বিশেষ এ সুবিধা আর বাড়ানো হবে না বলে জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পর আবারো নতুন নির্দেশনা জারি করে জানানো হয়, ২০২১ সালে একজন ঋণগ্রহীতার যে পরিমাণ পরিশোধ করার কথা, তার মধ্যে ১৫ শতাংশ পরিশোধ করলে গ্রাহক নিয়মিত থাকতে পারবেন।

 

এর পর ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা এবং শ্রেণিকৃত ঋণের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার যুক্তি দেখিয়ে ঋণখেলাপিদের আবারো বড় ছাড় দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে এখন আড়াই থেকে সাড়ে ৪ শতাংশ অর্থ জমা দিলেই চলবে বলে জানানো হয়।

 

এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলাপ করলে সংশ্লিষ্টরা জানান, এই ঋণে বড় সুবিধা দেয়া হয়েছে। একটু কঠিন না হলে খেলাপি ঋণ আরো বাড়বে বলে মনে করেন তারা। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ ৫ শতাংশের বেশি হলেই তা উদ্বেগজনক। কাজেই খেলাপি ঋণ কমানোর জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এখন জরুরি হয়ে পড়েছে।

 

তিনি উল্লেখ করেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে ছাড় দেয়ার কারণে খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

 

তিনি মনে করেন, খেলাপি ঋণ কমাতে যেসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল, তা ঠিক ছিল না বলেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সরাসরি অ্যাকশনে যেতে হবে।

 

তথ্যমতে, বর্তমানে খেলাপি ঋণ রেকর্ড পরিমাণ বেড়ে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে, যা মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ৯ শতাংশ। এ যাবৎকালে এটিই সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের অঙ্ক।

 

এদিকে বিদায়ী বছর শেষে রাষ্ট্রীয় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬০ হাজার ৫০১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৩.০৪ শতাংশ। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৬.২০ শতাংশ। বিদেশি ব্যাংকের খেলাপি ২ হাজার ৯৭১ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪.৭৭ শতাংশ এবং বিশেষায়িত তিনটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৪ হাজার ২৭৭ কোটি টাকা। এ অঙ্ক তাদের বিতরণ করা ঋণের ১১.৮০ শতাংশ।

 

বর্তমানে তফসিলি ব্যাংকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খেলাপি ঋণ রয়েছে সরকারের মালিকানাধীন জনতা ব্যাংকে। ব্যাংকটিতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২০ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার বেশি। তবে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিদেশি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের। ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৯৭.৯০ শতাংশই খেলাপি।

 

অবশ্য গত জুলাই- সেপ্টেম্বরে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির দিক থেকে শীর্ষে উঠে এসেছে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক। খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিতে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরের অবস্থানে রয়েছে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংকের নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।

 

অন্যদিকে ঋণের শীর্ষ দশে থাকা জনতা ব্যাংক থেকে অ্যাননটেক্স, ক্রিসেন্ট, নূরজাহানসহ অন্যান্য গ্রæপ মিলে হাতিয়ে নিয়েছে ১১ হাজার কোটি টাকার বেশি। বর্তমানে ব্যাংকটির মোট ঋণের মধ্যে খেলাপি হয়েছে ২৭.৮৩ শতাংশ। অর্থাৎ গত এক বছরে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। আর অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৪ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা। এছাড়া রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ২ হাজার ৮৯২ কোটি টাকা।

 

ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, উচ্চ খেলাপি ঋণের হার বিবেচনায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক (সাবেক ওরিয়েন্টাল)। এই ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণের ৮৩ শতাংশের বেশি খেলাপি। এই ওরিয়েন্টাল ব্যাংকে ২০০৬ সালে সীমাহীন ঋণ কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছিল। এই ব্যাংকের আমানতকারীদের অনেকেই এখনো আমানতের টাকা ফেরত পাননি। একইভাবে পদ্মা ব্যাংকের (সাবেক ফারমার্স ব্যাংক) খেলাপি ঋণের হার প্রায় ৬৭ শতাংশ। ব্যাংকটির বিতরণ করা ৫ হাজার ৮৪৩ কোটি টাকার মধ্যে ৩ হাজার ৮৪০ কোটি টাকাই খেলাপি। ঋণের শীর্ষ দশে থাকা বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৭ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকা বা ৫৮.৬২ শতাংশ। এই ব্যাংকটি থেকে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকা লোপাট করা হয়।

 

এদিকে শীর্ষ দশে থাকা সোনালী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ৪৪৪ কোটি টাকা বা ১৭.১৮ শতাংশ। এছাড়া অগ্রণী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে ১২ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা বা ১৯.২৮ শতাংশ। আর বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (বিডিবিএল) খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮৪৭ কোটি টাকা। যা মোট বিতরণ করা ঋণের ৪০.৭২ শতাংশ।

 

একইভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ৬ হাজার ৭২৬ কোটি টাকা বা ১৭.৫৮ শতাংশ। বিশেষায়িত রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকেও খেলাপি ঋণের আধিক্য বেশি। গত সেপ্টেম্বর শেষে এ দুটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ দাঁড়িয়েছে যথাক্রমে ৯.২৭ শতাংশ ও ২১.৪৯ শতাংশ। এ খাতের অপর ব্যাংক প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের খেলাপিতে পরিণত হয়েছে ১৩.৪৩ শতাংশ ঋণ। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংকগুলো উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ঋণ রয়েছে।

 

প্রসঙ্গত, ব্যাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী ব্যাংক খাতে গত এক বছরে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩৩ হাজার কোটি টাকা।

 

ভোরের আকাশ/নি

মন্তব্য

Beta version