-->
অর্থনীতিবিদ-উদ্যোক্তার বিতর্ক

সুদহার বাড়ানো ঝুঁকি তৈরি করবে

এটা মালিকদের লোভোস্ফীতির প্রকাশ : গোলাম রহমান

জাফর আহমদ
সুদহার বাড়ানো ঝুঁকি তৈরি করবে

জাফর আহমদ: ব্যাংক খাতে ঋণের সুদ ৯ শতাংশ। আমানতে সুদ ৭ শতাংশ। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি যেখানে ৯ শতাংশের ওপরে, সেখানে সুদহার বেঁধে রাখা যৌক্তিক নয়। আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সুদ বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশেও সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। কিন্তু এমন যুক্তি মানছে না দেশের ব্যবসায়ীরা-উদ্যোক্তারা।

 

তারা বলছেন, বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে দেশে দেশে সুদহার বাড়ানো হয়েছে, সে সব দেশের পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনা করে। এটা বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশে সুদ বাড়ালের ছোট্ট যে সব প্রতিষ্ঠান প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে আছে, সেগুলো বন্ধ হয়ে যাবে।

 

ব্যাংক খাতেদ সুদ ৯ শতাংশ বেঁধে দেয়া আছে। আমানতে সুদ ৬ শতাংশ বেঁধে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে আমানত সংগ্রহে সুদ ১ শতাংশ বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহ করছে। ঋণ বিতরণে সুদ ৭ শতাংশ বেঁধে দেয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর স্প্রেড কমে গেছে। কমে গেছে মুনাফা। এ অবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে সুদহার বাড়ানো হোক।

 

অর্থনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও দাবি তোলা হয়েছে সুদ হার বাড়ানো হোক। তাদের মতে, মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদহার বাড়ানো প্রয়োজন। দেশে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো অনেক বেশি। উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতে সুদহার বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অর্থনীতি বিদদের মতে, এখন যে মূল্যস্ফীতি তা হোমগ্রোন নয়, বৈশি^ক মূল্যস্ফীতির প্রভাব। ফলে আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশ মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে যে পদক্ষপ নিয়েছে, এখানেও তাই করা হোক।

 

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান এইচ মনসুর ভোরের আকাশকে বলেন, মূল্যস্ফীতির বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশ মুদ্রানীতিকে ব্যবহার করছে। বাংলাদেশেরও এটা করা উচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। ডলারের বিপরীতে টাকার মান স্থিতিশীল করতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সেই সব বড়লোককে সহায়ক যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে। কিন্তু ছোটদের জন্য ক্ষতির। সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীেিতকে সামাল দেয়ার উদ্যোগ নিতে হবে।

 

দেশে এখন মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে। বরাবরের মতো এ মূল্যস্ফীতি নিয়ে অর্থনীতিবিদদের অভিযোগ আছে। তাদের মতে, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো অনেক বেশি। মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেড়েছে, সে হিসাবই বলে দেয় প্রকৃত মূল্যস্ফীতি আরো বেশি। ফলে মূল্যস্ফীতি সামাল দিতে সুদহার বাড়ানোর বিকল্প নেই। অর্থনীতিবিদের এ যুক্তি সঙ্গে একমত নয় শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠন এফবিসিসিআই। এমনকি সুদ বাড়ানো নিয়ে ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবির দাবির সঙ্গেও একমত নয় তাদের অভিভাবক সংগঠন এফবিসিসিআই।

 

এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, ব্যাংক উদ্যোক্তারা সুদহার কমানোর ব্যাপারে দাবি তুললেও এ দাবি শুধু তাদেরই। এফবিসিসিআই সুদহার বাড়ানো পক্ষে নয়। দেশ এক ক্লান্তিকাল অতিক্রম করছে। করোনার মতো অতিমারি অতিক্রম করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরেক সমস্যায়। অনেক প্রতিষ্ঠান কোনমতে টিকে আছে। ৭০টি স্পিনিং মিলে বড় বিনিয়োগ হয়েছে। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান নানারকম হিসাব করে বিনিয়োগ করেছে; ব্যাংক ঋণ নিয়ে তারা বিনিয়োগ করেছে। এখন সুদহার বেড়ে গেলে তারা টাকা ফেরত দিতে পারবে না। এমন অনেক প্রতিষ্ঠান আছে সুদহার বেড়ে গেলে টিকে থাকবে না। ইকোনমিক রিপোটার্স ফোরামের অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

 

অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক উদ্যোক্তারা সুদহার বাড়ানোর যে দাবি তুলেছে, তা নিজ নিজ স্বার্থ রক্ষার জন্য করা হয়েছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। সুদহার বাড়ানো দাবি এখনো ইতিবাচক নয়। জসিম উদ্দিন বলেন, আমাদের যারা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রিসার্স (গবেষণা) করেন, তাদের কেউ আইএমএফকে রিপ্রেজেন্ট করেন, কেউ ওয়াল্ড ব্যাংকের রিপ্রেজেন্ট করেন। সুতরাং এখানে কে কী বলল, তার থেকে বড় কথা ইন্ডাস্ট্রি সারভাইভ করবে কিনা। এখন এমনিতেই আমাদের জ্বালানি নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। বড়, ছোট সব ব্যবসায়ী সমস্যায় রয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে সুদহার বাড়ালে অবস্থাটা কোথায় যাবে! এ অবস্থায় আমি মনে করি না, সুদহার বাড়িয়ে আমরা সমস্যার সমাধান করতে পারব বলে মত দেন জসিম উদ্দিন। মূল্যস্ফীতির সামাল দিতে যুক্তরাষ্ট্র সুদহার বাড়িয়েছে, এমন দাবি মানতে নারাজ শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের সভাপতি। এ ব্যবসায়ী নেতার দাবি, যুক্তরাষ্ট্র সুদহার বাড়িয়েছে বিশ্ব জুড়ে ডলারের তেজি ভাব তৈরি করার জন্য। সেটা হয়েছেও। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে হবে না। মূল্যস্ফীতিকে লাগাম পরানোর তাগিদ দেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান।

 

তিনিও অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকারদের মতে সায় দেন। সুদ হার বাড়ানো যাবে না, এ ধরনের দাবিকে উদ্যোক্তাদের ‘লোভোস্ফীতির’ বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, এটা বড় বড় ব্যবসায়ীদের কথা। তারা ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়। তারা চায় সুদ যাতে কম থাকে। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ চায় সুদ বেশি হোক। আমানত থেকে ঋণ বিতরণের মধ্যে পার্থক্য মাত্র ২। ৯ শতাংশের ওপরে মূল্যস্ফীতি, এটা জাস্টিফাইয়েবল নয়।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version